বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও একই আদেশ জারি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রেক্ষিতে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় এসব নির্দেশনা দেয়। নির্দেশনায় কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটের কথা বলা হলেও এর পেছনে ভিন্ন কারণ দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। হঠাৎ করে এই ইস্যুতে সরকারের হার্ডলাইনে যাওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ প্রায় দুই বছর বৈদেশিক ভ্রমণ সীমিত অবস্থায় ছিল। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ স্বাভাবিক হওয়ায় সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণও হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক সরকারি আদেশ জারি হচ্ছিল বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে। যেখানে প্রয়োজনীয় সফরের পাশাপাশি অপ্রয়োজনীয় অনেক সফরও রয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে সরকার কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। সরকারি কর্মকর্তাদের সফর বন্ধে আর্থিক সংশ্লিষ্টতার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে এসব সফরের উদ্দেশ্য ও ধরন নিয়ে সূত্র বলছে, অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশে যেসব ট্যুর আয়োজন হয় তার বেশির ভাগই কোনো কাজে আসে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যারা ট্যুরে যাচ্ছেন তাদের কাজের সঙ্গে ট্যুরের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় না। এ ছাড়া ওয়ার্কশপ, সেমিনার কিংবা স্টাডি ট্যুরকে পারিবারিক ট্যুর বানিয়ে ফেলছেন কর্মকর্তারা। ট্যুরের মূল আয়োজনে যোগ না দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরছেন এমন ঘটনাই বেশি ঘটছে। বিশেষ করে যারা ইউরোপে যাচ্ছেন তারা সরকারি আদেশের (জিও) বাইরে একাধিক দেশে ভ্রমণ করছেন। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারাও বিব্রত হচ্ছেন। সম্প্রতি সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তুরস্ক ভ্রমণ করেন। তার সঙ্গে একই মন্ত্রণালয়ের সচিব পরিবার নিয়ে যান। মন্ত্রীর খরচ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সচিবের খরচ মন্ত্রণালয় বহন করে। তাদের পরিবার নিজ খরচে ওই ট্যুরে অংশ নেয়। ট্যুরের বিষয়ে সরকারি আদেশ জারি হলেও মন্ত্রী কী উদ্দেশ্যে ভ্রমণ করছেন তা উল্লেখ ছিল না। ফলে এ নিয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়। বিদেশ সফর বন্ধের পেছনে ডলার সাশ্রয়কেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক লেনদেনে কড়াকড়ি আরোপ করছে সরকার। নগদ ডলার লেনদেনকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। ব্যাংকিং চ্যানেলের ডলার লেনদেনকে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের ঘনঘন বিদেশ সফরের কারণে বিপুল অঙ্কের ডলার বাইরে চলে যাচ্ছে। বৈধ সীমার বাইরে ডলার বহনের অভিযোগ রয়েছে কর্মকর্তা ও তাদের পরিবার পরিজনের বিরুদ্ধে। ২০২০ সালের নভেম্বরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন এক অনুষ্ঠানে তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ করেন, বিদেশে অর্থ পাচারকারীদের মধ্যে আমলাদের সংখ্যাই বেশি। যদিও মন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর সমালোচনার ঝড় ওঠে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর নিয়ে প্রায় দশ বছর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় একটি নীতিমালা প্রদান করেছিল। এরপর আর ওই নীতিমালা হালনাগাদ করা হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের নানামুখী সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। হঠাৎ করে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে মন্ত্রণালয়গুলোর কাজে বিঘ্ন ঘটতে পারে। কিছু অসৎ কমকর্তার কারণে পুরো মন্ত্রণালয় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধের সিদ্ধান্ত অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু এটা কোনো সমাধান নয়। অনেকটা মাথাব্যথার কারণে মাথা কেটে ফেলার মতো ঘটনা। এখানে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় কর্মকর্তারা সুযোগ নিচ্ছেন। ট্যুর সংশ্লিষ্ট কাজের সঙ্গে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই তারা অংশ নিচ্ছেন। পরবর্তীতে মন্ত্রণালয় বদল হলে তারা ভিন্ন বিষয়ে ট্যুর করছেন। আবার সফরসঙ্গীর নামে মন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাও বিদেশ সফর করে সরকারি অর্থের অপচয় করছেন।
উল্লেখ্য, গত ১২ই মে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের কথা জানিয়ে পরিপত্র জারি করে অর্থ বিভাগ। পরিপত্রে বলা হয়, কোভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে পুনরায় আদেশ না দেয়া পর্যন্ত সব ধরনের এক্সপোজার ভিজিট, স্টাডি ট্যুর, এপিএ ও ইনোভেশনের আওতাভুক্ত ভ্রমণ এবং ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশগ্রহণসহ সব ধরনের বৈদেশিক ভ্রমণ বন্ধ থাকবে। এর আগে ১১ই মে সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর বন্ধের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ব্যয় সংকোচনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানিয়ে সেদিন তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, এখন থেকে কোনো প্রয়োজন না থাকলে বিদেশ সফর আর নয়। যদি কোনো বিশেষ প্রয়োজন হয়, তাহলে তারা যাবেন। অন্যথায় কেউ যাবেন না। সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যয় ব্যবস্থাপনা শাখার এক পরিপত্রে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি স্বায়ত্তশাসিত, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানি, ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ সীমিত করার কথা বলা হয়েছে।