চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে আগুন থেকে ভয়াবহ রাসায়নিক বিস্ফোরণে ব্যাপক প্রাণহানীর ঘটনায় ডিপোর সার্বিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, ডিপোটির প্রবেশ পথেই সারি সারি কন্টেইনারে রাসায়নিক পদার্থ যেনতেনভাবে রাখা হয়েছে। খোলা আকাশের নিচে ছিল প্লাস্টিকের কন্টেইনারে ভর্তি বিপুল পরিমাণ কেমিক্যাল। ডিপোর বিরাট এলাকজুড়ে বিপজ্জনক কার্গো থাকলেও নিজস্ব অগ্নিনির্বাপের ব্যবস্থা ছিলো না বললেই চলে। এমন সব দাহ্য রাসায়নিক ডিপোতে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে রাখার ঘটনায় সংশ্লিষ্টরা চরম বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, সর্বনাশের মূলেই রয়েছে ডিপো কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনা। চট্টগ্রামের অন্যতম এই সেবরকারি ডিপোতে এমন বিপর্যয়ের পর নগরীর বন্দর-পতেঙ্গা এবং ভাটিয়ারী ও সীতাকুণ্ডের আশপাশে গড়ে উঠা ১৯টি ডিপোর সার্বিক নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
ডিপোর কর্মীদের বরাত দিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রথমে ডিপোর প্রবেশপথে একটি কেমিক্যাল ভর্তি কন্টেইনারে আগুনের সূত্রপাত। কিছু সময়ের মধ্যে ওই কন্টেইনার থেকে শুরু হয় ভয়াবহ বিস্ফোরণ। শনিবার রাত থেকে শুরু হওয়ায় ওই বিস্ফোরণ গতকাল রোববার বিকেল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠছে পুরো এলাকা। সেখানে বিপুল পরিমাণ ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড’ নামের দাহ্য রাসায়নিক রয়েছে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস ও ডিপোর কর্মীরা। ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা বলছেন, এই কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। হাইড্রোজেন পারক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড বিস্ফোরক হিসেবে আচরণ করে।
ফায়ার সার্ভিসের ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাইন উদ্দিন ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিস্ফোরণে কন্টেইনার থেকে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ায় আগুন নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘ সময় লাগছে। বিস্ফোরক পরিদফতর বলছে, হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের মতো অধিক দাহ্য কেমিক্যাল মজুত করার অনুমতি নেয়নি প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি বিস্ফোরক অধিদফতরের তালিকায় ওই প্রতিষ্ঠানের নামও নেই। ফায়ার সার্ভিসের ডিজি জানান, ডিপোর লোকজন ঘটনাস্থলে না থাকায় কোথায় কোন ধরনের কেমিক্যাল রয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আর তাতে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের বেগ পেতে হয়।
বিএম কন্টেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শনে গিয়ে ডিপোর লোকজন না দেখে রেগে যান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান। এসময় তিনি বলেন, কাজের সুবিধার্থে ডিপোর কোথায় কোন রফতানি পণ্য, কোথায় কেমিক্যাল পণ্য তা ফায়ার কর্মীদের দেখিয়ে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ডিপোর লোকজন থাকার দরকার ছিল। অথচ এখানে এসে আমি কাউকে পেলাম না, ডিপোর লোকজন কোথায়? তিনি বলেন, এত বড় একটা ঘটনা। অথচ ভেতরে ডিপোর লোকজন কেউ নেই। এটা খুবই দুঃখজনক। তারা এখানে উপস্থিত থেকে ফায়ারের লোকজনকে গাইড করতে পারতো। বন্দর চেয়ারম্যান বলেন, এই ডিপোতে রফতানি পণ্য রয়েছে। আমাদের দেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেমিক্যাল রফতানি হয়। এখানে ডিপোর মুখে ২৬টি কেমিক্যাল ভর্তি কন্টেইনার ছিল। এই ডিপোতে আইএসপিএস কোড কমপ্লায়েন্স বা নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। বিপজ্জনক পণ্য রাখার জন্য ডিপোতে আলাদা ইয়ার্ডও ছিলো বলে জানান তিনি।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক-সংলগ্ন সীতাকুণ্ডের শীতলপুর এলাকায় ৭০ কানি জায়গার ওপর কন্টেইনার ডিপোটি অবস্থিত। স্থানীয় আমদানি-রফতানি করা বিভিন্ন পণ্য এই ডিপোতে রাখা হয়। ডিপোর ভেতরে ৫০০ মিটারের একটি টিনের শেড রয়েছে। এই শেডের ভেতরে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড নামে একটি কেমিক্যাল রয়েছে। এগুলো বিদেশে রফতানি করা হয়। রফতানির জন্য হাটহাজারীর ঠান্ডাছড়ির আল-রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্সে উৎপাদিত হাইড্রোজেন পার অক্সাইড কন্টেইনারে করে এই ডিপোতে রাখা হয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সালে আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমান ও সুইজারল্যান্ডের এক ব্যক্তির যৌথ মালিকানায় ডিপোটি চালু হয়। এটি স্মার্ট গ্রুপের সহযোগি প্রতিষ্ঠান। আমদানি-রফতানি করা বিভিন্ন পণ্য এই ডিপোতে রাখা হয়। তবে স্মার্ট গ্রুপের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের সবধরনের কাগজপত্র রয়েছে। এমনকি কাস্টমসের ছাড়পত্রেও তা উল্লেখ আছে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বিএম কন্টেইনার ডিপোসহ অন্য সব ডিপোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থায় রয়েছে গলদ। দাহ্য পদার্থ আমদানিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের কড়াকড়ি নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, বিস্ফোরণের প্রাথমিক সূত্রপাত কেমিক্যালের কন্টেইনার থেকে বলা হলেও বিএম কন্টেইনার ডিপোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মারাত্মক ত্রুটির কথা জানা গেছে প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত কর্মচারীদের কাছে। কর্মীরা জানান, ডিপোর ভেতরে নিজস্ব জ¦ালানি তেলের মজুদও রয়েছে।
গণবসতিপূর্ণ এলাকায় কিভাবে ডিপো
বিএম কন্টেইনার ডিপোর মতো নগরী এবং আর আশপাশে গণবসতিপূর্ণ এলাকায় গড়ে উঠেছে বেসরকারি ডিপো। এসব ডিপোতে আমদানির-রফতানিমুখি রাসায়নিক পদার্থ মজুদ করা হচ্ছে। কিন্তু যথাযথ তদারকি না থাকায় এমন বিপর্যয় ঘটেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এমন ডিপো আবার তাতে রাসায়নিকের অনিরাপদ মজুদ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সীতাকুণ্ডের সংসদ সদস্য দিদারুল আলম গতকাল বিএম ডিপো পরিদর্শনকালে এমন প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, লোকালয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কীভাবে রাসায়নিক ডিপো করা হয়েছে, তা তদন্ত করা উচিত। বিএম কন্টেইনার ডিপোটির আশপাশে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। শনিবার রাতের বিস্ফোরণে আশপাশের অনেক বাসিন্দার ঘরের দরজা-জানালা ভেঙে গেছে। ঘরের সামনে ভাঙা কাঁচের স্তুপ উড়ে গেছে অনেকের ঘরের টিনের চাল।
এদিকে ডিপোতে কী পরিমাণ মালামাল ছিল সে বিষয়ে মালিক পক্ষ কোন তথ্য দেয়নি। তবে বেসরকারি ডিপো মালিকদের সংগঠন বিকডার সেক্রেটারি রুহুল আমীন শিকদার বলেন, চট্টগ্রামের ১৯টি ডিপোর মধ্যে এটির অবস্থান তৃতীয়। বিএম কন্টেইনার ডিপোর ধারণ ক্ষমতা ছয় হাজার টিইইউএস। অগ্নিকাণ্ডের সময় সেখানে আমদানি পণ্যবাহী আটশ এবং রফতানি পণ্যবাহী পাঁচশ কন্টেইনার ছিলো। আর খালি কন্টেইনার ছিল তিন হাজার। রুহুল আমীন দাবি করেন নিরাপত্তা মেনেই সেখানে কেমিক্যাল মজুদ রাখা হয়েছিলো।