জিকে (গঙ্গা-কপোতাক্ষ) সেচ প্রকল্পের তিনটি পাম্পের মধ্যে দুটি বিকল হয়ে পড়ায় চলতি খরিপ-২ মৌসুমে আমন আবাদসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন নিয়ে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন কুষ্টিয়াসহ চার জেলার কয়েক লাখ কৃষক। তীব্র তাপপ্রবাহ আর খরার সঙ্গে পাম্প মেশিন বিকল হওয়ার বিড়ম্বনায় দিশেহারা এ অঞ্চলের কৃষকরা। এ অবস্থায় চলিত খরিপ-২ মৌসুমে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সূত্র জানায়, বোরো-আমন অর্থাৎ খরিপ-১ ও ২ মৌসুমের ফসল উৎপাদনের জন্য কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা ও চুয়াডাঙ্গা জেলার ১৩ উপজেলার কয়েক লাখ কৃষক জিকে সেচ প্রকল্পের ওপর অনেকটায় নির্ভরশীল। যদিও বেশ কয়েক বছর ধরে এই প্রকল্পের কাঙ্ক্ষিত সুফল থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। তার পরও প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু থাকলে কৃষকরা কিছুটা হলেও সুফল পেয়ে থাকেন। কিন্তু এ বছর ১৬ জুন থেকে শুরু হওয়া খরিপ-২ মৌসুমের শুরুতেই একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেতে হয় কৃষকদের। খরিপ-২ মৌসুমের আওতায় আমন ধান উৎপাদনের জন্য পানি সরবরাহ করার লক্ষ্যে পাম্প চালু করতে গিয়ে প্রকৌশলীরা তিনটির মধ্যে মাত্র একটি পাম্প সচল আর দুটি বিকল দেখতে পান। জিকে প্রকল্পের মূল স্টেশনটি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলায় অবস্থিত। একটি চ্যানেলের মাধ্যমে পদ্মা নদী থেকে পানি নিয়ে মূল খালে ফেলা হয়। জানা যায়, ১৯৫৪ সালে প্রায় ৪ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়ার লক্ষ্যে জিকে সেচ প্রকল্প চালু করা হয়। ২০০৫ সালে স্থাপন করা তিনটি পাম্প দিয়ে বছরে ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ আক্টোবর পর্যন্ত ) দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা পানি উত্তোলন করা যায়। বাকি দুই মাস রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাম্প তিনটি বন্ধ রাখা হয়। তিনটি পাম্প সচল থাকলে চার জেলার ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খালে পানি সরবরাহ করা সম্ভব হয়। আর সেচ প্রকল্পের প্রধান এবং শাখা খালগুলোতে পানি থাকলে এখান থেকে কৃষকরা নিরবচ্ছিন্ন সেচ সুবিধা পান। তিনটি পাম্প একসঙ্গে চালু থাকলে প্রতি সেকেন্ডে তিন হাজার ৯০০ কিউসেক পানি আবাদি জমিতে দেওয়া সম্ভব হয়। এদিকে, তিনটি পাম্পের মধ্যে দুটি পাম্প বিকল থাকায় চরম বিপাকে পড়েছেন কুষ্টিয়াসহ চার জেলার কয়েক লাখ কৃষক। কুষ্টিয়া সদর উপজেলার বৃত্তিপাড়া এলাকার কৃষক রবজেল আলী বলেন, এমনিতেই চাহিদা মতো সার পাওয়া যাচ্ছে না, তার ওপর ডিজেলের দাম অনেক বেড়েছে। এর সঙ্গে বাড়তি যোগ হওয়া পানি সংকটে তারা একেবারে দিশেহারা। কুমারখালী উপজেলার নাফদিয়া গ্রামের কৃষক আবুল হাশেম জানান, আমনের ভরা মৌসুমে তাদের এখন থেকে কয়েক মাস পানির খুব দরকার। কিন্তু জিকে সেচ প্রকল্পের পাম্প নষ্ট থাকায় তারা পানি পাচ্ছেন না। বাধ্য হয়ে তাদের ডিজেলচালিত শ্যালো মেশিন দিয়ে জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে। কিন্তু ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় জমিতে একবার সেচ দিতে প্রায় এক হাজার টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে তাদের পক্ষে ফসল চাষ করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। জানতে চাইলে কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ির উপ-পরিচালক ড. হায়াত মাহামুদ বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই জিকে সেচ প্রকল্প থেকে কুষ্টিয়াসহ চার জেলার কৃষকরা তাদের কাঙ্ক্ষিত সেচ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছিল। প্রকল্পের পাম্প কবে কখন সচল থাকে তা বলা মুশকিল। তারপরও যতটুকু পাওয়া যাচ্ছিল এখন দুটি পাম্প বিকল থাকায় বিশেষ করে আমন ধান চাষাবাদ নিয়ে চরম ভোগান্তির মুখে পড়েছেন কুষ্টিয়াসহ এ অঞ্চলের কৃষকরা। তিনি বলেন, আমন ধান উৎপাদনের শুরু (জুন) মাস থেকেই জমিতে সেচের প্রয়োজন হয়। সেপ্টেম্বর মাসে মাঝারি পরিমাণ সেচ দরকার হলেও সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় অক্টোবর মাসে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এবার এ অঞ্চলের কৃষকদের নিজেদেরই সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ৮৮ হাজার ৮৯৫ হেক্টর জমিতে আমন ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তবে আবাদ হয়েছে ৮৮ হাজার ৯১৯ হেক্টর। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, দুটি পাম্প বিকল থাকায় মাত্র একটি দিয়ে বর্তমানে সেচ কার্যক্রম সচল রাখা হয়েছে। এতে করে কুষ্টিয়াসহ চার জেলার কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু পাম্প মেশিনগুলো জাপানের ইবারা কোম্পানির তৈরি। যে কারণে দেশীয় প্রকৌশলীদের মাধ্যমে এটি সচল করা সম্ভব হবে না। এরই মধ্যেই সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করে এগুলো মেরামতের জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু তারা এ বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু এখনো আমাদের জানায়নি। তবে আশা করছি, দ্রুতই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।