‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে উঁকি মারে আকাশে। মনে সাধ, কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়, একেবারে উড়ে যায় কোথা পাবে পাখা সে।’ বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তালগাছ’ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে তালগাছ লাগানোর প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সারাদেশে ৩৮ লাখের মতো তালগাছ লাগানো হলেও এখন সেই তালগাছের খোঁজ নেই। কোথায় গেল সেই তালগাছ? এ প্রকল্প বাস্তবায়নে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে বলে জানা গেছে। সেই তালগাছের চারা খুঁজছেন জেলা প্রশাসক ও ইউএনওরা।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি সচিবালয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, তালগাছ লাগিয়ে বজ্রপাত মোকাবিলার কৌশলে ইতি টেনে দিয়েছে সরকার। বজ্রপাত থেকে বাঁচাতে দেশজুড়ে এক কোটি তালগাছ লাগানোর যে পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার, তা আর বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ৩৮ লাখের মতো তালগাছ লাগানোর পর দেখা গেল, যত্নের অভাবে মারা যাচ্ছে। তাই এটা বাতিল করে দিয়েছি।
সারাদেশে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তালগাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল গত ২০১৭ সালে। জেলা, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তার দুই ধারে লাগানো হয়েছিল তালের চারা। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে লাগানো তালের চারা গুলো গত পাঁচ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। আদৌ তালের গাছের চারা রোপান করা হয়েছিল কিনা তা নিয়ে জনমনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কোথায় কতগুলো বীজ লাগানো হয়েছিল এবং সেগুলো এখন কী অবস্থায় আছে স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন থেকে খুজে পাচ্ছে না বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক জেলা প্রশাসক ইনকিলাবকে বলেন, আমি তো তখন জেলায় ছিলাম না। সেই সময় কতগুলো তাল গাছের চারা রোপন করেছিলো সেটির কোন তথ্য জানা নেই। তবে এ জেলায় এ প্রকল্পের খোজ খবর নেয়া হচ্ছে।
বজ্রপাতে প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ায় ২০১৭ সালে সরকার ১০ লাখ তালগাছ রোপণের পরিকল্পনা নেয় সরকার। এখন আর সেই প্রকল্প চলমান নেই। তিনি বলেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে আশ্রয়কেন্দ্র ও লাইটনিং এ্যারেস্টার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। খোলা জায়গায় যারা থাকবে তাদের জন্য ছোট করে লাইটনিং সেন্টার ও লাইটনিং এ্যারেস্টার স্থাপন করা হবে।এরই মধ্যে কয়েকটি এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে ৪০টি বজ্রপাত অ্যারেস্টার বসানো হয়েছে।
জানা গেছে, গত ২০১৬ সালে সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রতি বছর বজ্রপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ছে। সারাদেশে কোন না কোন স্থানে বজ্রপাতে মানুষ, গবাদিপশু ও বন্যপ্রাণী মারা যাচ্ছে। আবহাওয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আমাদের দেশে এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত বজ্রপাতের আশঙ্কা বেশি থাকে এবং সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলতে থাকে। মৃত্যুর সংখ্যা বিচারে এখন প্রতি বছর বর্ষাকালে বজ্রপাত ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক বছরে সহস্রাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সাড়ে ১০ বছরে বজ্রপাতে দেশে আড়াই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। চলতি এ বছরের সাড়ে পাঁচ মাসে বজ্রপাতে মারা গেছে শতাধিক মানুষ।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, দেশে বজ্রপাতের ঘটনা আগের চেয়ে বেড়েছে। গত ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত বজ্রপাতে মারা গেছে ২ হাজার ২৭৬ জন। ২০১১ সালে মারা গেছে ১৭৯ জন, ২০১২ সালে মারা গেছে ২০১ জন, ২০১৩ সালে মারা গেছে ১৮৫ জন, ২০১৪ সালে মারা গেছে ১৭০ জন, ২০১৫ সালে মারা গেছে ১৬০ জন, ২০১৬ সালে মারা গেছে ২০৫ জন, ২০১৭ সালে মারা গেছে ৩০১ জন, ২০১৮ সালে মারা গেছে ৩৫৯ জন, ২০১৯ সালে মারা গেছে ১৯৮ জন, ২০২০ সালে মারা গেছে ২১১ জন এবং ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত মারা গেছে ১০৭ জন। বজ্রপাতে প্রতিবছর গড়ে দুই শতাধিক মানুষ মারা যায়।
জলবায়ু পরিবর্তন আর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বজ্রপাত বাড়ছে। তাপমাত্রা যত বেশি হবে বজ্রপাত তত বাড়বে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ৪০ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৭ ডিগ্রী বৃদ্ধি পেয়েছে। এক ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়লে ২০ শতাংশ বজ্রপাত বেড়ে যায়। এ হিসাবে বজ্রপাত বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বজ্রপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ ভীত হয়ে পড়েছে। বর্ষাকালে বজ্রপাত বেশি হয়। বাংলাদেশে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বজ্রপাতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
বজ্রপাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা হিসেবে তালগাছ লাগানোকে বিশেষজ্ঞরা গুরুত্ব দিচ্ছেন। বজ্রপাত নিরোধে তালগাছ বেশ কার্যকর। বিশেষজ্ঞারা বলছেন, তালগাছে কার্বনের স্তর বেশি থাকায় তা বজ্রপাত নিরোধে সহায়তা করে। কারণ তালগাছের বাঁকলে পুরু কার্বনের স্তর থাকে। তালগাছের উচ্চতা ও গঠনগত দিক থেকেও বজ্রপাত নিরোধে সহায়ক হতে পারে। তালগাছের পাশাপাশি নারকেল গাছ, সুপারি গাছ এর মতো উচ্চতা সম্পন্ন গাছ বজ্রপাত নিরোধে বেশ কার্যকরী। প্রকৃতি দিয়েই প্রকৃতিকে রক্ষা করতে হবে।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারা দেশে কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) কর্মসূচি বাস্তবায়নের প্রধান শর্তই দেওয়া হয়েছিল এর আওতায় নির্মিত রাস্তার দুই পাশে তালগাছের চারা রোপান করা হবে। বন বিভাগের পরামর্শে এ কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান করার কথা স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের। জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও প্রতিটি উপজেলার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ কর্মকর্তা এই কার্যক্রম নজরদারি করবে বলেও নির্দেশনা রয়েছে। বজ্রপাতে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ২০ হাজার টাকা এবং আহত ব্যাক্তিকে ৫ হাজার টাকা সহায়তা দেওয়া হয়। এ ছাড়াও বজ্রপাতে নিহত পরিবার প্রতিমাসে সরকারের কাছ থেকে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় ৩০ কেজি চাল পান।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বজ্রাঘাতে মৃত্যু ঠেকাতে দেশব্যাপী তালগাছ রোপণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ২০১৭ সালে। উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের রাস্তার দুই ধারে লাগানো হয়েছিল তালের চারা। ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে লাগানো তালের আঁটিগুলো গত কয়েক বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। আদৌ তালের চারা লাগানো হয়েছিল কিনা তা নিয়ে সন্দেহের কথা জানিয়েছেন অনেকে কোথায় কতগুলো বীজ লাগানো হয়েছিল এবং সেগুলো এখন কী অবস্থায় আছে সে বিষয়ে খোঁজ নেবেন বলে জানিয়েছে স্থানীয় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, বর্তমানে অপঘাতে মৃত্যুর ঘটনায় এখন কালবৈশাখী-ঘূর্ণিঝড়, বন্যা-জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প-অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে নতুন দুর্যোগ হিসেবে যুক্ত হয়েছে বজ্রপাত। বিষয়টি সরকারকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এটিকে নতুন দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এ কারণেই ২০১৬ সাল থেকে বজ্রপাতকে সরকারিভাবে দুর্যোগ ঘোষণা করা হয়েছে। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশের প্রায় সর্বত্রই তালগাছসহ বড় বড় গাছের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে যাওয়ার কারণে বজ্রপাতে মানুষের প্রাণহানি হচ্ছে।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, আগে বজ্রপাত হলে তা তালগাছ বা অন্য কোনও বড় গাছের ওপর পড়তো। বজ্রপাত এক ধরনের বিদ্যুৎ রশ্মি। তাই বজ্রপাতের ওই রশ্মি গাছ হয়ে তা মাটিতে চলে যেত। এতে জনমানুষের তেমন ক্ষতি হতো না। কিন্তু এখন গ্রামের পর গ্রাম ঘুরলেও এখন আর তালগাছ দেখা যায় না। একইভাবে বড় আকারের গাছও এখন আর তেমন নেই। দেশব্যাপী বনায়ন হলেও তা আকারের দিক থেকে বড় হয়ে ওঠেনি। মূলত এ কারণে বজ্রপাতে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে মনে করেন সরকারের সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া বজ্রপাতের আগাম পূর্বাভাস পাওয়া যায় না। তাই এ দুর্যোগ থেকে সাধারণ মানুষ যেন রেহাই পায় সেজন্যই দেশব্যাপী তালগাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
বজ্রপাত ঠেকাতে তাল গাছ নয়, দেশব্যাপী তালের চারা (বীজ) লাগানো হয়েছে। ইতোমধ্যেই রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিন পার্বত্য জেলা বাদ দিয়ে ৬১টি জেলায় কমবেশি পরিমাণের তালের বীজ লাগানো হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩১ লাখ ৬৪ হাজার তালের চারা লাগানো হয়েছে।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের সচিব ইনকিলাবকে বলেন, কাবিখা কর্মসূচির আওতায় দেশব্যাপী নির্মিত রাস্তার দুই পাশে তালের বীজ লাগানো হয়েছে। এ শর্ত দিয়েই কাবিখা চলেছে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ এর দেখভাল করছে। ডিসি, ইউএনও এবং জেলার ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা সামগ্রিকভাবে এর মনিটর করছে।