আফগানিস্তানের সুদীর্ঘ ইতিহাসে যে সামান্য কয়েকজন নারী ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন গওহর সাদ তাদের অন্যতম। তিনি ভাষা-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সংস্কৃতির প্রসারে অনন্য সাধারণ অবদান রাখেন। আফগানিস্তানের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য স্থাপত্য এখনো তাঁর কীর্তি ও অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশেষত আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ হেরাতে তার বহু স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে।ইরানের গওহর সাদ মসজিদ তাঁর সবচেয়ে বড় স্মৃতিস্মারক। যা খোরাসানের ইমাম রেজা প্রাঙ্গণে অবস্থিত। গওহর সাদ ছিলেন তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের শাসক শাহরুখের স্ত্রী। যিনি তাঁর পিতার পর ৪৩ বছর বর্তমান ইরান ও আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শাসন করেন।
শাহরুখ ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে তৈমুরিদ সাম্রাজ্যের রাজধানী সমরকান্দ থেকে হেরাতে স্থানান্তর করেন। গওহর সাদ আনুমানিক ১৩৭৮ খ্রিস্টাব্দে উজবেকিস্তানের সমরকান্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা গিয়াস উদ্দিন তারখান ছিলেন তৈমুরিদ সাম্রাজ্যেরঅন্যদিকে শাহরুখ ছিলেন ‘তাজিক’ মায়ের গর্ভে জন্ম নেওয়া তৈমুরের ছেলে। পিতাই তাঁকে ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দে খোরাসানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। এর ৯ বছর পর ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন-সার্বভৌম সাম্রাজ্যের ঘোষণা দেন। প্রথমে সমরখন্দ ও জাবুলুস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে মধ্য এশিয়ায় সাম্রাজ্য বিস্তার করেন।
গওহর সাদ ও তাঁর স্বামী শাহরুখ উভয়ে ছিলেন জ্ঞানের সেবক ও শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক।
প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। মোঙ্গলীয় শাসক চেঙ্গিস খান তাঁর পরিবারকে ‘তারখান’ উপাধি দিয়েছিলেন।শিল্প, শিল্পী, স্থপতি, দার্শনিক, কবি ও বিজ্ঞানীদের প্রতি তাঁরা ছিলেন অত্যন্ত উদার ও মুক্তহস্ত। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যে নবযুগের সূচনা হয়। তাদের সময়ে ফারসি ভাষা ও সাহিত্যের রেনেসাঁ সংঘটিত হয়। জগদ্বিখ্যাত সুফি কবি আল্লামা জামি ছিলেন শাহরুখ যুগের শ্রেষ্ঠ উপহার। শাহরুখ নিজেও ছিলেন একজন ধার্মিক, জ্ঞানী ও দক্ষ মানুষ। সম্ভবত এসব গুণের কারণে পিতা অন্য সন্তানদের তুলনায় তাঁকে বেশি ভালোবাসতেন। স্বাধীন রাজ্য ঘোষণার পর পিতার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হলেও পরবর্তী সময়ে তা দূর করেন এবং পিতাকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন।
শাহরুক চেঙ্গিস খান ও তৈমুরের অভিযানের সময় ধ্বংস হয়ে যাওয়া হেরাত শহরের নিরাপত্তাপ্রাচীর পুনর্নির্মাণ করেন। এ ছাড়া শহরে বহু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো তৈরি করেন। স্বামীর এই উন্নয়নকাজে সহযোগী ছিলেন গওহর সাদ। শাহরুখ ১৩৮৮ খ্রিস্টাব্দে গওহর সাদকে বিয়ে করেন। তিনি রাজ্যের বিভিন্ন সংকট সমাধানে মধ্যস্থতা করতেন এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে সমাধান দিতেন। রাজনৈতিক ও প্রাশাসনিক কাজে স্বামীকে পরামর্শ দিতেন এবং সহযোগিতা করতেন। রাজ্য পরিচালনার নীতিনির্ধারণ এবং রাজ্যের কার্যনির্বাহী বিভাগে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। সাধারণত সফরেও স্বামীর সঙ্গে থাকতেন।
গওহর সাদ নিজের সহায়-সম্পদ ও জ্ঞান শিল্প ও সাহিত্যের সেবায় ব্যয় করেন। শিক্ষা ও জনকল্যাণমূলক বহু স্থাপনা তাঁর অর্থায়নে সম্পন্ন হয়েছে। অসহায় মানুষকে সাহায্য করা ছিল তাঁর প্রিয় কাজগুলোর একটি। তিনি হেরাতে একটি আধুনিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ মাদরাসায় দূর-দূরান্তের শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন করতে আসত। এমনকি তিনি নারীদের জন্য পৃথক মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে দুই শতাধিক নারী শিক্ষার্থী ছিল। তিনি মাদরাসা প্রাঙ্গণে একটি চমৎকার সমাধিসৌধ নির্মাণ করেন এবং সেখানেই তাঁকে, সন্তান ও স্বামীকে দাফন করা হয়। তাঁর স্বামী শাহরুখ ‘রাই’ শহরে ইন্তেকাল করেছিলেন।
১৪৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বামী মারা যাওয়ার পর পর্দার অন্তরাল থেকে তিনি রাজ্য পরিচালনা করেন। ১৯ জুলাই ১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আবু সাঈদের নির্দেশে এই মহীয়সী নারীকে হত্যা করা হয়। আফগানিস্তানের হেরাতে অবস্থিত গওহর সাদ সমাধিসৌধ ও মুসাল্লায়ে গওহর সাদ এবং ইরানের খোরাসানে অবস্থিত গওহর সাদ মসজিদ এখনো তাঁর কীর্তির সাক্ষ্য বহন করে। ২০১০ সালে কাবুলে রানি গওহর সাদের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়।
তথ্যসূত্র : কাবুল টাইমস, আরব নিউজ ও উইকিপিডিয়া