মুখ দেখে অন্তর্নিহিত মানুষকে বোঝা দায়। কার ভেতর কি আছে কে-ই বা জানে ! আপাতদৃষ্টিতে মানুষ হতে পারে সুন্দর কিংবা কদাকার। বেশ-ভূষায় মনে হতে পারে ধনী কিংবা দরিদ্র। শিক্ষা, পরিচয় ও পদ-পদবি দেখে মনে হতে পারে মানুষটি প্রতিষ্ঠিত, সফল ও সুখী। আসলে কি তাই? ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’ বলছে,‘সুখ’-এর র্যাংকিয়য়ে বাংলাদেশ এগোচ্ছে। বিশ্বের ১৪৬টি ‘সুখী দেশ’-এর তালিকায় বাংলাদেশ ৯৪ নম্বরে। গত বছরও এই অবস্থান ছিল ১০১ নম্বরে। জাতিসংঘের এই ইনডেস্ক বলছে, বাংলাদেশে সুখ বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবতা কি বলে?
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০২১ সালে ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। বাংলাদেশের সামাজিক সংগঠন ‘আঁচল ফাউন্ডেশন’-এর তথ্য মতে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যা ৪৪.৩৬ শতাংশ বেড়েছে। বর্ধিত হারে আত্মহননের পথ বেছে নেয়াদের মধ্যে নারী ৫৭ ভাগ ও পুরুষ ৪৩ ভাগ। দেশে প্রতিদিন গড়ে ৩৫ জন মানুষ আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছেন।
পুলিশের হিসাবের খাতায় দেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ শুধু ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। ফাঁসি দিয়ে এবং বিষ খেয়ে আত্মহত্যার বাইরে অন্য পদ্ধতিগুলো অবশ্য পুলিশের হিসাবে নেই। ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শুধু রাজধানীতেই আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে ২ হাজার ১৬৬টি। ডিএমপি’র তথ্য মতে, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে ২ হাজার ১৬৬টি।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০২০ সালে আত্মহত্যা বেড়েছে ১৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে ১৪ হাজার ৪৩৬টি। এ সময় নারীরা আত্মহত্যা করেন বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বছরে বিশ্বে ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতিদিন আত্মহত্যা করে ২ হাজার ১৯১ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর বিশ্বে ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। প্রতিদিন আত্মহত্যা করে ২ হাজার ১৯১ জন। বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা থেকে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতা বেশি। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিত্তশালী এবং সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের আত্মহত্যার ঘটনা বাড়ছে। সমাজবিদদের সহজ প্রশ্নÑ দেশে সুখী মানুষের সূচক যদি বাড়বেই তাহলে আত্মহননের হার বাড়ছে কেন? এই উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিশেজ্ঞদের কপালে পড়ছে চিন্তার ভাঁজ।
গত বছর ১৫ সেপ্টেম্বর ৯ তলা ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন ব্যারিস্টার ইভানা লায়লা চৌধুরী। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এক সন্তানের জননী ইভানার ব্যারিস্টার স্বামী তাকে তালাক প্রদানের হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু তালাক হলে ইভানার বাবা-মা সমাজে ছোট হয়ে যাবেন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে উপায়ন্তর না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন এই মেধাবী উদীয়মান আইনজীবী। বিত্তশালী পরিবারের সন্তান ইভানা। প্রতিষ্ঠা পেতে যাচ্ছিলেন আইন পেশায়। আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগে ইভানার পরিবারের পক্ষ থেকে করা মামলাটি এখন তদন্তাধীন।
গত ২৯ মার্চের ঘটনা। নওগাঁর পত্নীতলার আকবরপুর চেরাডাঙ্গা গ্রামে নিজের লাইসেন্সকৃত বন্দুকে আত্মহত্যা করেন ইয়াকুব আলী (৫৫)। বিত্তশালী হওয়ায় নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা রক্ষায় নিজের লাইসেন্সকৃত একনলা একটি বন্দুক ছিল তার। ঘটনার দিন সকালের কোনো এক সময় সবার অজান্তে বাড়ির ছাদে বন্দুক নিয়ে গিয়ে নিজের মাথায় গুলি করেন। তার স্ত্রী মর্জিনা খাতুন গুলির শব্দ শুনে ছাদে যান। সেখানে ইয়াকুবের লাশ পড়ে থাকতে দেখেন।
গত ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ধানমন্ডিতে লাইভে এসে নিজের বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যা করেন ব্যবসায়ী আবু মহসিন খান (৫৮)। আত্মহত্যার সময় তিনি নানা হতাশার কথা বলছিলেন।
এরকম একটি-দু’টি নয়। গত বছর ২৩ সেপ্টেম্বর গাজীপুরে ফেসবুক লাইভে এসে ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেন পূবাইলের স্বপন চন্দ্র দাস নামের এক ব্যবসায়ী। গত বছর ১৭ আগস্ট মৌলভীবাজারে সুমন নামের এক জাদুশিল্পী ফেসবুক লাইভে এসে গলায় কাপড় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন। এর আগে ২৪ মার্চ লক্ষ্মীপুরে একইভাবে চুরির দায়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আদালত ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন এক তরুণ। ২০২০ সালের ৫ নভেম্বর সিলেটে এক তরুণ আত্মহত্যা করেন ফেসবুক লাইভে।
চলতি মাসের মে মাসে খুলনার সোনাডাঙ্গায় নারী ডাক্তারের আত্মহত্যার পর মামলা হয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, আগের বিয়ের তথ্য গোপন করে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক কর্মকর্তা ডা. সুহাস রঞ্জন হালদার ইন্টার্নি ডাক্তার মন্দিরা মজুমদারের সঙ্গে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। মন্দিরা চাপ দিলে সুহাস রঞ্জন বিয়ে করতে অস্বীকার করেন। শেষ অবধি আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ডা. মন্দিরা। সোনাডাঙ্গার বাসা থেকে তার ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
আত্মহননের পথ বেছে নেন সংবাদকর্মী সোহানা পারভীন তুলি (৩৮)। গত ১৩ জুলাই রাজধানীর রায়েরবাজারের ভাড়া বাসা থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এমন আত্মহননের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে।
সর্বশেষ আত্মহননের পথ বেছে নেন খুলনা ডিএসবির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিসি) খন্দকার লাবনী (৩৬)। মাগুরার শ্রীপুর সারাঙ্গদিয়া গ্রামে নানা বাড়িতে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। ২২ জুলাই তার লাশ উদ্ধার করা হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর অফিসিয়াল শর্টগান মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেন লাবনীর সাবেক বডিগার্ড কনস্টেবল মাহমুদুল হাসান (২৩)। ২৩ জুলাই মাগুরা পুলিশ লাইন ভবনের ছাদে তার লাশ পাওয়া যায়।
এসব ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, আত্মহত্যার কারণগুলো ভিন্ন ভিন্ন। অভিন্নতা শুধু একটি জায়গায়। তারা কেউ সুখী নন। অথচ তারা প্রায় সবাই প্রতিষ্ঠিত, বিত্তশালী কিংবা উচ্চ শিক্ষিত।
‘সুখ’ একটি আপাত বিষয়। এটি একটি মানবিক উপলব্ধির নাম। সুখ মনের একটি অবস্থা বা অনুভূতি, যা ভালোবাসা, তৃপ্তি, আনন্দ বা উচ্ছ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জৈবিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক, দর্শনভিত্তিক এবং ধর্মীয় দিক থেকে সুখের সংজ্ঞা এবং এর উৎস নির্ণয়ের চেষ্টা করা হয়। তবে সুখের চূড়ান্ত সংজ্ঞা এখনও সুনির্দিষ্ট, সুনির্ণীত নয়। তাই আপাতদৃষ্টিতে যাকে সুখী মনে হচ্ছে প্রকৃত অর্থে তিনি সুখী নাও হতে পারেন। সুখী মানুষের ভিড়েই মানব মনের গোপন অলিন্দে কখন কোন্ অসুখ বাসা বাঁধেÑ আগে থেকে আন্দাজ করা কঠিন। আত্মহত্যার মতো চূড়ান্ত পরিণতির মধ্য দিয়েই চিহ্নিত হয় মানুষের ‘সুখ’-‘অসুখ’।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের মতে, রাগে-ক্ষোভে আকস্মিকভাবে আত্মহত্যার চেয়ে ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।
মানসিক স্বাস্থ্যও যে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই গুরুত্বপূর্ণ সেটি আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না। নগরজীবন গতিশীল এবং অস্থির। কেউ কারো দিকে তাকানোর সুযোগ কম। কেউ কাউকে বুঝতেও চায় না। এ কারণে বিশ্বের নগরে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। গত দেড় দশকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও একটি কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যায় অনেকে ‘বীরত্ব’ খুঁজছেন। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
রাগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)-এর গবেষণা মতে, করোনার প্রথম বছর মানুষের মধ্যে ৪৬ শতাংশের মধ্যে বিষণ্নতা, ৩৩ শতাংশের মধ্যে দুশ্চিন্তার লক্ষণ মিলেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম মনে করেন, বহুমাত্রিক অভিঘাতই মানুষকে চরম সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক ও সামাজিক বৈষম্য মানুষকে হতাশায় ফেলে দিচ্ছে। আর এই হতাশা থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। এর বাইরে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণেও মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। নিজেকে যখন কেউ অপ্রয়োজনীয়, অর্থহীন মনে করেন তখনই সে আত্মঘাতী হয়। তবে আত্মহননকারীরা সব কারণের মূল উপকরণ পায় রাষ্ট্র, সমাজ থেকে কাছে থাকা মানুষ থেকে।
তিনি বলেন, করোনা অভিঘাতে সঙ্কটাপন্ন মানুষ বেড়েছে। মানুষ মানুষের বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। জীবন নিয়ে সংশয়, দারিদ্র্যতা, হতাশা, শূন্যতা বেড়েছে। এসব দূরীকরণের কার্যকর কোনো উদ্যোগ পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্র নেয়নি। শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
‘আঁচল ফাউন্ডেশন’-এর প্রধান নির্বাহী তানসেন রোজ বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বহুল ব্যবহারের মাঝেই পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা বেড়েছে। সার্বিক অস্থিরতার অভিঘাতে পরিবারগুলো আর্থিক চাপে পড়েছে। এই চাপ পরিবারের তরুণ সদস্যদের মধ্যে হতাশার সঞ্চার করে। ২০২০ সালে দেশে ১০১ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহননের পথ বেছে নেন। তারা একা। তাদের পাশে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র নেই। এই গ্যাপগুলো দূর করতে হবে। তরুণদের স্বপ্নবাদী করে তুলতে হবে। আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে হবে। তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা যাবে না। সঙ্কটের উৎসস্থলে হাত না দিলে আত্মহত্যার প্রবণতা বিস্তৃত হতেই থাকবে বলেও মনে করেন এই তরুণ সংগঠক।