প্রবাদে রয়েছে ‘জীবনের অপর নাম পানি’। রাজধানী ঢাকায় বসবাসরত কোটি মানুষের যাপিত জীবনে ‘পানিই জীবন পানিই মরণ’ হয়ে গেছে। পবিত্র রমজান মাসে লাখ লাখ রোজাদার ওয়াসার ময়লা পানি পান করে ইফতার করছেন; সাহরি খাচ্ছেন। তবে কিছু মানুষ বিকল্প ব্যবস্থায় পানি কিনে খাচ্ছেন। অথচ সামান্য বৃষ্টি হলে রাজধানীর শত শত মহল্লায় প্রধান সড়ক ও অলিগলির সড়ক পানিতে ডুবে যায়। ইফতারের জন্য পানি পাচ্ছেন না অথচ মানুষকে রাস্তায় জমে থাকা পানি মারিয়ে যাতায়াত করতে হয়। এই পানিই রাজধানীর মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছেন।
রমজান মাসে ওয়াসার সাপ্লাইয়ের পানি বেশির ভাগ এলাকায় ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত। শনিরআখড়া, রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী, টিকাটুলি, কমলাপুর, ওয়ারী, মগবাজার, মালিবাগ এবং মিরপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ওয়াসার পানি ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত। কয়েকদিন আগে ওয়াসার এমপি নিজেও স্বীকার করেছেন, পাইপে কোথাও লিকেজের কারণে হয়তো এমনদশা হতে পারে। ফলে পবিত্র রমজান মাসে লাখ লাখ রোজাদার রোজা রাখছেন পয়সা দিয়ে কিনে অল্প পানি পান করে। শরীরে প্রয়োজন এক লিটার; কিন্তু তিনি হাফ লিটার পানি পান করে রোজা রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। রোজাদাররা খাবার পানি পাচ্ছেন না। অথচ বৃষ্টির পানি অলিগলির রাস্তায় জমে থাকায় পানির কারণেই চলাচল করতে পারছেন না।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ওয়াসা থেকে সিটি করপোরেশনের কাছে রাজধানীর খালগুলো হস্তান্তর একটি ভালো উদ্যোগ। দায়িত্ব পাওয়ার পর সিটি করপোরেশন খালগুলো উদ্ধারে কাজ করছে। তবে রাজধানীবাসীকে পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি দিতে দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তা না হলে প্রতি বছর খালগুলো শুধু খনন আর পরিষ্কার করা হবে, দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যাবে না। আর নগরবাসী যেন বিশুদ্ধ পানি পায়, সে লক্ষ্যে ওয়াসাকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
গত ২২ এপ্রিল রাজধানী ঢাকায় কালবৈশাখী ঝড় হয়েছে। ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টিতে রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়া, গ্রিন রোড, কাঁঠালবাগান, কারওয়ানবাজার, ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোড, আসাদগেট, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক, মতিঝিলের কিছু অংশ, গ্রিনরোড, সোনারগাঁও মোড়, রামপুরা ও খিলগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকা, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ সংলগ্ন এলাকায় বৃষ্টির পানি জমে যায়। অনেক এলাকায় পানি অল্প সময়ের মধ্যে নেমেও গেলেও অনেক সড়ক থেকে পানি নামতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়। বেশ কয়েকটি প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে পানি জমে যাওয়ায় দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে নগরবাসীর কপালে। ‘মার্নিং সোজ দ্য ডে’ ইংরেজি প্রবাদের মতোই তারা বুঝতে পেরেছেন এবারের বর্ষা মৌসুমেও হয়তো ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলছে না! কারণ সামান্য বৃষ্টিতে রাজধানীর সড়কের এই হাল!
জানা যায়, এতদিন রাজধানীর সড়কে পানি আটকে থাকার কারণ হিসেবে সিটি করপোরেশন ঢাকা ওয়াসাকে দায়ী করে আসছিল। কারণ, ঢাকা শহরের খাল ও ড্রেনগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ওয়াসার। কিন্তু ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর দুই সিটি করপোরেশনকে খাল ও ড্রেনগুলোর দায়িত্ব হস্তান্তর করে ঢাকা ওয়াসা। দায়িত্ব পাওয়ায় আশার আলো জ্বলে নগরবাসীর মনে। এবার বুঝি পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলবে। দায়িত্ব পাওয়ার পর দুই সিটি করপোরেশন কাজও শুরু করে। কিন্তু তারা কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে এবারের বর্ষাতেও পানিবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাচ্ছেন না রাজধানীবাসী। তবে সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি, পুরোপুরি পানিবদ্ধতা নিরসন না হলেও আগের তুলনায় ভোগান্তি কম হবে এবার।
গত বুধবার ভোরে আধাঘণ্টার বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় রাজধানীর কাজীপাড়ার প্রধান সড়কসহ আশপাশের এলাকা। ভোগান্তিতে পড়েন স্থানীয়রা। গত শুক্রবার কালবৈশাখী ঝড় রাজধানীর ওপর দিয়ে বয়ে যায়। অতঃপর মহানগরীর বিভিন্ন সড়ক পানিতে ডুবে যায়। অলিগলির রাস্তাগুলোতে হাঁটু পানি জমে যায়। এ সময় কথা হয় ঢাকা বাসের সদস্য অ্যাডভোকেট মুহম্মদ মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সারাজীবন শনিরআখড়ার ও আশপাশের বাসিন্দারা পানিবদ্ধতার ভোগান্তি ভোগ করে আসছে। এবার খালগুলো সিটি করপোরেশনের অধীন আসার পর ভেবেছিলাম পানিবদ্ধতা আর হবে না। কিন্তু সামান্য বৃষ্টিতে এ এলাকায় পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। তাহলে লাভ কী হলো? স্বাভাবিকভাবে উপলব্ধি করা যায়, এবারের বর্ষা মৌসুমেও আমাদের পানিবদ্ধতার দুর্ভোগ পোহাতে হবে। শ্যামপুরের মোহাম্মদ বাগের বাসিন্দা আবদুর রব বলেন, বৃষ্টি হলেই সড়কে পানি জমে যাওয়া খুবই বেদনাদায়ক। খাওয়ার জন্য পরিষ্কার পানি পাচ্ছি না; অথচ বৃষ্টি হলেই পানির জন্য ঘর থেকেই বের হতে পারি না। একাধিক সাংবাদিক জানালেন, বৃষ্টি হলেই পানিবদ্ধতার মুখে পড়ে রাজধানীর মিরপুরের কাজীপাড়া, গ্রিন রোড, কাঁঠালবাগান, কারওয়ানবাজার, তেজকুনিপাড়া, তেজতুরী বাজার গার্ডেন রোড, ধানমন্ডির ২৭ নম্বর রোড, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক ও মতিঝিল এলাকা। এছাড়া পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড, বংশাল রোড, বঙ্গভবন এলাকা, টিকাটুলি, শ্যামপুর, কদমতলী, ধনিয়া, মুগদা, কিছু অংশে পানিবদ্ধতা দেখা যায়। বাড্ডা লিংক রোডের বাসিন্দা হাসিনুর রহমান বলেন, বৃষ্টি হলেই পানিবদ্ধতা এটা এ এলাকার স্বাভাবিক চিত্র। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন থেকে অনেকবার বলা হয়েছে, আগের মতো পানিবদ্ধতা হবে না। কিন্তু গতবার পানিবদ্ধতায় ভুগেছি। একদিনের বৃষ্টিতেই পানি জমতে দেখলাম। এবারের বর্ষা মৌসুমেও রক্ষা পাব না।
প্রতি বছরই পানিবদ্ধতায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। বৃষ্টি হলেই নগরীর অলিগলি ও ছোট পরিসরের রাস্তাগুলোতেও পানি জমে যায়। পানি নিষ্কাশনের পথগুলো আবর্জনায় ভরাট থাকায় যথাসময়ে বৃষ্টির পানি বের হতে পারে না। উল্টো ড্রেন উপচে পড়া ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত পানি ছড়িয়ে পড়ে শহরময়। ড্রেনেজ লাইন নিয়মিত পরিষ্কার না করায় এবং খালগুলোর পানি প্রবাহ ঠিক না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায়, রাজধানীর বেশিরভাগ সড়ক।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, খালগুলো দখলমুক্ত করে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে। প্রথমে খালে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হবে। এরপর খাল এলাকার সৌন্দর্য বাড়ানো হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন হলে বর্ষাকালে ডুববে না রাজধানী। মুষলধারে বৃষ্টি হলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পানি খাল ও ড্রেন দিয়ে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু নদীতে নেমে যাবে। তবে, আসন্ন বর্ষার আগে সবকাজ শেষ করা সম্ভব নয় বিধায়, এবারও রাজধানীর কিছু কিছু এলাকায় পানিবদ্ধতা দেখা দেবে আশঙ্কা সিটি করপোরেশনের কর্তাব্যক্তিদের।
খাবার পানি সঙ্কট : রমজান মাস চলছে। লাখ লাখ রোজাদার তীব্র পানি সঙ্কটে বিপর্যস্ত। রমজান শুরু আগ থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে তীব্র পানির সঙ্কট। পানি নিয়ে শুরু হয়েছে হাহাকার। বেশিরভাগ এলাকায় ওয়াসার সরবরাহ লাইনে পানির চাপ কমে গেছে। কোনো কোনো এলাকায় টানা কয়েকদিন ধরে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। কোথাও পানি ময়লা-দুর্গন্ধযুক্ত। একদিকে গ্রীষ্মের তাপদাহ ও অন্যদিকে রোজা, এ দুইয়ের কারণে বেড়েছে পানির চাহিদা। কিন্তু পানির সরবরাহ বৃদ্ধির পরিবর্তে কমেছে। পবিত্র রমজান মাসে অনেক এলাকায় রান্না ও অন্যান্য জরুরি কাজ কিছুই ঠিকভাবে হচ্ছে না পানির অভাবে। কোনো কোনো এলাকায় আবার মসজিদেও পানির সঙ্কট তৈরি হয়েছে। মুসল্লিরা অজু করতে গিয়ে সমস্যায় পড়ছেন। আবার কিছৃু কিছু এলাকায় পানির দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও পাম্প ঘেরাও করছে বিক্ষুব্ধ জনতা। আর এ সুযোগে ওয়াসার একশ্রেণির অসাধু কর্মচারীরা পানি বাণিজ্য শুরু করেছে। সাধারণত এক গাড়ি পানির দাম ৫শ’ টাকা। কিন্তু এই সুযোগে এসব অসাধু চক্র প্রতি গাড়ির পানির দাম ৮০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা নিচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পানি না পেয়ে অনেকে মিনারেল বোতলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। আবার কেউ কেউ গোসলসহ প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আসছেন আত্মীয়দের বাসা থেকে। যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, জুরাইন, ধোলাইপাড়সহ অনেক এলাকায় দিনে দু’একবার পানি সরবরাহ হলেও তাতে দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকায় পান করা যাচ্ছে না। পানির এমন পরিস্থিতিতে অনেকে ডায়রিয়াসহ নানাবিধ পেটের পীড়ায় ভুগছেন।
সারদিন রোজা রেখে ইফতারে পানি পাচ্ছেন না লাখ লাখ রোজাদার। যাদের টাকা রয়েছে, তারা মিনারেল ওয়াটার কিনে খাচ্ছেন। কেউ কেউ ওয়াসার বিশেষ কার্ডের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকার ডিপটিউবলের পানি ক্রয় করছেন।
কদমতলীর জিয়া স্মরণীর ভুক্তোভোগী মোশাররফ হোসেন বলেন, পানির জন্য ভাড়াটিয়া চাপ দিচ্ছেন বাড়িওয়ালকে, আর বাড়িওয়ালা ওয়াসা কর্তৃপক্ষকে। কিন্তু, সমাধান হচ্ছে না কিছুতে। ফলাফল, গৃহস্থালীর কাজকর্ম ও সুপেয় পানি যোগাড় করতে প্রতিদিন বাড়তি খরচ গুনতে গুনতে রোজাদারের অবস্থা কাহিল। অথচ মাস শেষে ঠিকই ওয়াসার পানির বিল দিতে হচ্ছে।