সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সেরা দশে ছিলেন। বয়স ২৯ বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সেরা সুন্দরী নির্বাচিত হন। এরপর চোখে শুধুই আলোর ছটা। রাতভর পার্টি। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে এক সময় সর্বনাশা মাদক ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়েন। সুন্দরী প্রতিযোগিতা দিয়ে শুরু হলেও মাদকের কবলে পুরো ক্যারিয়ার বিনাশ হয় এই তরুণী তারকার। রাজধানীর নামকরা একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। অল্প বয়স থেকেই তার স্বপ্ন অভিনেত্রী হবেন।
একটু একটু করে সেই স্বপ্নের পথে এগোচ্ছিলেন। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে সেরাদের তালিকায় নিজের স্থান তৈরি করে নেন। খ্যাতি যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠিক তখনই মাদকে সবকিছু তছনছ করে দেয়। মিডিয়া জগতের প্রযোজক, পরিচালক, সহ-অভিনেতা আর কাজ নিয়ে দিনরাত ব্যস্ত থাকতেন। হঠাৎ করে নিজের সুন্দর ক্যারিয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ে যান। ব্যক্তিগত জীবনে ভালোবাসার যে মানুষটি এসেছিলেন তার সঙ্গেও সম্পর্কের টানাপড়েন শুরু হয়। এরপর একটু একটু করে নেশার জগতে জড়াতে শুরু করেন। ইয়াবার পাশাপাশি হেরোইন, সিসাসহ একাধিক মাদকে জড়িয়ে পড়েন।
শুরুর দিকে তারকা খ্যাতি অর্জন করার পর বেশ কিছু নাটক ও সিনেমায় নিয়মিত কাজ করলেও একটা সময় হাতে কাজ না থাকায় হতাশার অতলে হারিয়ে যান। মাঝরাতে বাসায় ফেরা। কখনো আবার দু’তিন দিনেও ফিরতেন না। বাসায় দরজা বন্ধ করে সারাক্ষণ নিজের মতো করে থাকতেন। একটা পর্যায়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেন। কিছু জানতে চাইলে বাবা-মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, বাসার জিনিসপত্র ভাঙচুরসহ অদ্ভুত আচরণ শুরু করেন। পরবর্তীতে পরিবারের সদস্যরা তাকে রাজধানীর পান্থপথের একটি রিহ্যাব সেন্টারে ভর্তি করেন। সেখানে কয়েক মাস চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফেরেন। পরবর্তীতে এর সাত থেকে আট মাস পর পুনরায় মাদক নিতে শুরু করেন এই তারকা। বর্তমানে তিনি কিছুটা সুস্থ হলেও মাঝেমধ্যেই তাকে কাউন্সেলিং ও রিহ্যাবে চিকিৎসা নিতে হয়। মাদকের কারণে তারকা জগতের খুব বেশি কারও সঙ্গে এখন আর যোগাযোগ নেই এই সুন্দরীর। অনেকটা আড়ালে আবডালেই এখন নিঃসঙ্গ সময় কাটছে তার। সমীর হোসেন। সাবেক এক মন্ত্রীর ছোট ভাই। ২০ বছর বয়স থেকে নেশার জগতে। এক সময় প্যাথেড্রিনে আসক্ত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তাকে রাজধানীর গুলশানের একটি মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর পরবর্তীতে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
এরপর নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মধ্যে থাকতে হতো তাকে। বর্তমানে সমীর বিদেশে আছেন। সুস্থ জীবনযাপন করছেন। মলি-কলি দুই বোন। বয়স ১৮ থেকে ১৯ বছর। থাকেন রাজধানীর গুলশানে। বাবা বিত্তবান। অল্প বয়সে মুটিয়ে যাওয়ায় বন্ধুদের পরামর্শে স্লিম হওয়ার জন্য ইয়াবা সেবন শুরু করেন। একপর্যায়ে তাদের দলে মা’কে ভেড়ান। বয়স হয়ে যাওয়ায় মা’ও দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছিলেন। মেয়েদের পরামর্শে তিনিও নিয়মিত ইয়াবা নিতে শুরু করেন। ফলে তাদের খাবারের প্রতি আগ্রহ কমে যায়। এবং শারীরিকভাবে শুকাতে শুরু করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ইয়াবার প্রতিক্রিয়ায় তারা মানসিকভাবে অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন। প্রথমে দুই বোনকে পরবর্তীতে তাদের মাকে একই মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা গ্রহণ শেষে বর্তমানে তারা সুস্থ জীবনযাপন করছেন। মলি এবং কলি দু’বোনেরই বিয়ে হয়েছে। তাদের কোলজুড়ে এসেছে ফুটফুটে সন্তান। এখন তারা পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। সজল। বয়স ২২ বছর। মগবাজার, ওয়ারী, ধানমণ্ডিসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বাবার অগাধ সম্পত্তি। বহুতল বাড়ি। টাকার অভাব নেই। বাবা ইঞ্জিনিয়ার। দাদা প্রতিষ্ঠিত এবং অভিজাত ব্যক্তিত্ব।
এক নামেই তাদের স্থানীয়রা চেনেন। সজল পড়ালেখা না করায় তাকে কারিগরিভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলেন তার পরিবার। বাবার অঢেল সম্পত্তি। মাস শেষে লাখ লাখ টাকা বাসা ভাড়া সব মিলিয়ে ইয়াবা থেকে শুরু করে সকল প্রকার নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েন। একটা পর্যায়ে পরিবার বিষয়টি জানতে পারলে তাকে খরচ দেয়া বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে বাবার গাড়ির চাকা থেকে শুরু করে গাড়ির গুরুত্বপূর্ণ পার্টস বিক্রি করে নেশার টাকা জোগাতে শুরু করেন। এরপর তাকে একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। সেখানে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েছেন। গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিয়মিত কাউন্সেলিং নিচ্ছেন। মাদক নিরাময় কেন্দ্রে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে সেখান থেকে প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত ল্যাপটপ চুরি করে পালিয়ে যায় সজল। পরবর্তীতে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। মাদকের টাকা জোগাতে স্ত্রীর সকল স্বর্ণের গহনা, শাশুড়ির অলংকার থেকে শুরু করে পরিচিত যাদের যা পান তাই চুরি করতেন। বর্তমানে যদিও তিনি সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন।
রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডের একটি পরিবারের ভাই-বোন, বোন জামাইসহ পুরো পরিবারই মাদকাসক্ত। সেন্ট্রাল রোডের বাসিন্দা রুজিনা। নিজে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে চাকরি করতেন। স্বামী ব্যাংক কর্মকর্তা। হঠাৎ করে ব্যাংকার রাজনের আচরণে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করেন তার পরিবার। সামান্য কথাতেই রেগে যাওয়া। কাজে অমনোযোগী। কারণে অকারণে মিথ্যা বলা। স্ত্রীর গায়ে হাত তোলাসহ বিভিন্ন আচরণগত পরিবর্তন দেখা দেয়। এ সময় তাকে রাজধানীর একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। রাজনকে নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তির পর তার স্ত্রী শ্বশুর-শাশুড়িসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খারাপ আচরণ শুরু করেন। এবং রিহ্যাব সেন্টার থেকে স্বামীকে বাসায় ফিরিয়ে আনার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন। রুজিনা বোঝাতে চান তার স্বামীর কোনো সমস্যা নেই। তিনি সুস্থ আছেন। এ সময় রুজিনার ডোপ টেস্ট করালে তার মাদকাসক্তের বিষয়টি ধরা পড়ে। এবং পরবর্তীতে তাকেও একই নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। এ সময় রুজিনা জানান, স্বামীর সঙ্গে তিনিও নিয়মিত ইয়াবা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মাদক সেবন করতেন। যেটা তিনি সকলের কাছে গোপন রেখেছেন।
এরপর রুজিনা জানান তার কলেজপড়ুয়া ভাইও নিয়মিত মাদক গ্রহণ করেন। এরপর একই পরিবারের তিন সদস্যকে রিহ্যাব সেন্টারে পৃথকভাবে ভর্তি করে চিকিৎসা করানো হয়। বর্তমানে রুজিনা এবং তার ব্যাংকার স্বামী কিছুটা সুস্থ হলেও নির্দিষ্ট সময় পরপর তারা কাউন্সেলিং নিয়ে থাকেন। রুজিনার ভাই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বর্তমানে উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় অবস্থান করছেন। মুক্তি মানসিক হাসপাতাল ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালক ডাক্তার আলী আসকার কোরেশী মানবজমিনকে বলেন, মানসিক হাসপাতাল ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের দীর্ঘ ৩৫ বছরে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। আমাদের সামাজিক অস্থিরতা এর জন্য অন্যতম দায়ী। সকলের একটাই উদ্দেশ্য শুধু টাকা কামাতে হবে। অবৈধভাবে কামানো অর্থ পেয়ে আমাদের সন্তানরাই যে মাদকের মতো মরণঘাতীতে ডুবে নিজের এবং পরিবারের ধ্বংস ডেকে আনছে এটা আমরা বুঝতে পারি না। তিনি বলেন, আমাদের প্রথম প্রজন্ম যারা শিক্ষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভালো একটি অবস্থানে যাওয়ার পর তাদের প্রথম টার্গেট থাকে কীভাবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানো যাবে। কাজেই আমাদের এখন সুশিক্ষার প্রয়োজন। পাশাপাশি এক্ষেত্রে শুধু ছেলেমেয়েকে দোষ দিলে হবে না। এর জন্য বাবা-মা অন্যতম দায়ী।