জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাস ভাড়া বেড়েছে। বাস ভাড়া সমন্বয় করতে গতকাল বিকালে বিআরটিএর সঙ্গে বৈঠকে বসেন বাস মালিক সমিতির নেতারা। মহানগরীতে বাস ও মিনিবাসে ৩৫ পয়সা এবং দূরপাল্লার বাসে কিলোমিটারপ্রতি ৪০ পয়সা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আজ থেকে নতুন ভাড়া কার্যকর হবে। তবে লঞ্চের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করতে আজ বৈঠকে বসবে বিআইডব্লিউটিএ। এদিকে দাম বাড়ায় বিভিন্ন স্থানে পাম্প বন্ধ থাকায় বিক্ষোভ, ভাঙচুর ও মানববন্ধন হয়েছে। একই কারণে রাজধানীর সড়কে গণপরিবহনের সংকট দেখা গেছে। বাসের সংখ্যা কম থাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও অনেকে বাসে উঠতে পারেননি। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন অফিসসহ বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা।
বাড়ল বাস ভাড়া : জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মহানগরে প্রতি কিলোমিটারে বাস ও মিনিবাসে ভাড়া ৩৫ পয়সা বাড়িয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। দূরপাল্লার বাসে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে কিলোমিটারপ্রতি ৪০ পয়সা। গতকাল রাজধানীর বনানীতে বিআরটিএর কার্যালয়ে অংশীজনদের সঙ্গে বাস ভাড়া পুনর্নির্ধারণী বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার। উপস্থিত ছিলেন সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী, সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহসহ অন্য অংশীজনেরা। বিকাল ৫টায় শুরু হওয়া এই বৈঠক চলে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত। পরে ব্রিফ করেন সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী এবং বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার।
বিআরটিএ চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আমরা বাস ভাড়া পুনর্নির্ধারণী বৈঠক করেছি। পাশাপাশি আমদানি ব্যয় বাড়ায় বাসের বিভিন্ন সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধির কারণেও বাসমালিকদের কিছু দাবি ছিল। বৈঠকে সবার আলোচনা পর্যালোচনার ভিত্তিতে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এখন থেকে মহানগর পর্যায়ে কিলোমিটারে বাসে ২ টাকা ৫০ পয়সা ও মিনিবাসে ২ টাকা ৪০ পয়সা ভাড়া হবে। দূরপাল্লার বাসে ভাড়া হবে কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ২০ পয়সা। আগে ভাড়া ছিল মহানগর পর্যায়ে কিলোমিটারে বাসে ২ টাকা ১৫ পয়সা ও মিনিবাসে ২ টাকা ১০ পয়সা। দূরপাল্লার বাসে ভাড়া ছিল কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৮০ পয়সা।
গণপরিবহনের সংকট : জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির পরপরই রাজধানীর সড়কে গণপরিবহনের সংকট দেখা গেছে। সকাল থেকেই স্বাভাবিক সময়ের মতো বাস ছিল না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে দাঁড়িয়েও গণপরিবহনে উঠতে পারেননি অনেকে। বাসের সংখ্যা কম থাকায় বড় ভোগান্তিতে পড়েছেন অফিসসহ বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা। গতকাল রামপুরা, বাড্ডা, লিংক রোড, মহাখালী ও শ্যামলীর মিরপুর রোড এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
এসব এলাকায় দেখা গেছে, বাসের জন্য মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। প্রতিটি মোড়ে যাত্রীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। মাঝেমধ্যে দু-একটি বাস এলেও সেগুলো ছিল যাত্রীতে ঠাসা। দু-একজন নেমে গেলে সেই শূন্যস্থান পূরণে হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়। এতে দু-একজনের বাসে ঠাঁই হলেও বাকিরা হতাশ হয়ে পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করেছেন। অনেকে বাসে উঠতে পারবেন না এমন আশঙ্কা থেকে বিকল্প উপায়ে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। বাস সংকটের কারণে পোয়াবারো অবস্থা ছিল রিকশাচালকদের। সুযোগ বুঝে তারাও যাত্রীদের কাছ থেকে নিয়েছেন বাড়তি ভাড়া। সিএনজি অটোরিকশাচালকদেরও যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া নিতে দেখা গেছে। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সংখ্যা বাড়ায় ভোগান্তি বেড়েছে।
বাড্ডা লিংক রোড এলাকায় বাসের জন্য অপেক্ষায় থাকা যাত্রী সুলতান মাহমুদ বলেন, ‘এখন সকাল সাড়ে ৯টা বাজে। সকাল সোয়া ৮টা থেকে এখানে বাসের অপেক্ষায় আছি। ইতিমধ্যে এক ঘণ্টা পার হলেও বাসে উঠতে পারিনি। কারণ অধিকাংশ বাস গেট বন্ধ করে আসছে।’
বিভিন্ন স্থানে পাম্প বন্ধ, বিক্ষোভ প্রতিবাদ : জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর, বিক্ষোভ, প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করেছে পরিবহন মালিক, চালকসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
ঢাকা : রাজধানীর শ্যামলীতে পেট্রল ও ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে। এ সময় পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। গতকাল দুপুরে এ ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা ২টার পর শ্যামলী শিশুমেলার সামনে ক্ষুব্ধ মানুষজন জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেন। এ সময় রাস্তা দিয়ে একটি পুলিশের গাড়ি যাচ্ছিল। পরে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের গাড়িটি ঘিরে ধরেন এবং ভাঙচুর চালান। এদিকে জ্বালানি তেলের বাড়তি দাম প্রত্যাহার না করলে হরতাল করবে বলে জানিয়েছে সিপিবি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। দলটি বলছে, জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বাড়িয়ে সরকার ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে। জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে সরকারের উচিত ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া। জ্বালানির বর্ধিত দাম প্রত্যাহার না করলে জেলা-উপজেলায় ঘেরাও, অবরোধ এবং প্রয়োজনে হরতালের মতো কর্মসূচি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। গতকাল রাজধানীর পল্টনে প্রতিবাদ সমাবেশ শেষে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এ ঘোষণা দেন। জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বিকালে রাজধানীর পল্টন মোড়ে এই প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এ সময় রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ডিজেল, কেরোসিনসহ জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি সরকারের অপরাধমূলক কাজ। তেলের দাম বাড়লে যাতায়াতসহ সবকিছুর দাম বাড়বে। এতে অর্থনীতিতে চাপ পড়বে। বিপর্যস্ত হবে জনজীবন। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের রেকর্ড পরিমাণ মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে অবরোধ, বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়েছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। গতকাল বিকালে রাজধানীর শাহবাগ মোড় আটকিয়ে প্রতিবাদ জানান শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ এবং পরে মোটরবাইক নিয়ে মশাল মিছিল করে ছাত্র ফেডারেশন। একই সময়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ব্যানারে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদ জানান কিছু শিক্ষার্থী। এসময় যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটলেও সমাবেশের পাশ দিয়ে যানবাহন চলতে থাকে। সমাবেশ ঘিরে চারদিকে অবস্থান নেয় পুলিশ। সেখানে আধাঘণ্টা অবস্থানের পর জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা।
চট্টগ্রাম : ভাড়া পুনর্নির্ধারণ না করে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির করায় গতকাল চট্টগ্রাম নগরে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রাখে বাসমালিকদের বিভিন্ন সংগঠন। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। যদিও বেলা ২টায় গণপরিবহন চালু করার সিদ্ধান্তের কথা জানায় মালিক সংগঠনগুলো। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘ভাড়া পুনর্নির্ধারণ না করে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করায় আজ (গতকাল) সকাল থেকে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে চালকদের অনুরোধ করি গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামার জন্য। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) সঙ্গে বৈঠকে বসবে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। এরপর আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্তে যাব।’
সিলেট : জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে সিলেটে সড়ক অবরোধ এবং টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছেন যানবাহনের চালক ও মালিকরা। মূল্য বৃদ্ধির খবর পেয়ে শুক্রবার রাত ৯টা থেকে সিলেটের সব কটি পাম্প তেল বিক্রি বন্ধ করে দেয়। পাম্প থেকে তেল বিক্রি না করায় তারা বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ এবং টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন। এদিকে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে গতকাল থেকে সিলেট-সুনামগঞ্জ রুটে বাস ভাড়া বৃদ্ধি করেছেন পরিবহন মালিকরা।
রংপুর : জ্বালানি তেল ও ইউরিয়া সারের মূল?্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল, লোডশেডিং বন্ধ, ভুল নীতি, দুর্নীতির জন?্য দায়ীদের শাস্তি, নিত?্যপ্রয়োজনীয় দ্রব?্য ও সব কৃষি উপকরণের দাম কমানোর দাবিতে গতকাল কৃষক সংগ্রাম পরিষদ রংপুর প্রেস ক্লাব চত্বরে মানববন্ধন ও সমাবেশ করে।
বগুড়া : জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে গতকাল বগুড়া থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বেশ কিছু বাস বন্ধ ছিল। বাস বন্ধ রাখায় দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। বগুড়ায় পূর্বঘোষণা ছাড়াই দূরপাল্লার ও অভ্যন্তরীণ রুটে ডিজেলচালিত বেশির ভাগ বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়। গতকাল সকাল থেকেই শুরু হয় এই অঘোষিত ধর্মঘট। বগুড়ার কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে রংপুর, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুর, নগরবাড়ীসহ রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি।
ফেনী : জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনী অংশে যান চলাচল সীমিত হয়ে পড়ে। মহাসড়কে ছিল না যানবাহনের তেমন চাপ। এদিকে দাম বাড়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছে কৃষি উন্নয়ন পরিষদ। গতকাল সকালে কৃষি উন্নয়ন পরিষদের ব্যানারে তেল, সার ও ওষুধসহ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ফেনী শহরের ট্রাক রোডে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ ছাড়া যশোর, রাঙামাটি, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, দিনাজপুর জেলায় একই পরিস্থিতি ছিল বলে আমাদের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।