প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নিজস্ব অর্থায়নে বহু প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত বিশ্বের দরবারে দেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করেছে। আগামী ২৫ জুন যান চলাচলের জন্য সেতুটি খুলে দেয়া হবে। একই সাথে তিনি চলতি ভরা বোরো মৌসুমে চালের দামের ঊর্ধ্বগতি রোধে বাজার দেখে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে তিনি ওই নির্দেশ দেন। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, বাজার দেখে, কারা চালের মজুত করছে সেটা দেখে, দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছে মন্ত্রিসভা। মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, চাল ও তেল নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। মার্কেট সার্ভে করে দ্রুত অ্যাকশনে যেতে বলা হয়েছে। তেলের মতো চাল ইস্যুতেও অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মজুত করলে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বিশেষ করে চাল ও তেল নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। এই ভরা মৌসুমে চালের দাম কেন বেশি? গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং কিছু সাজেশন ছিল, এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আমাদের মার্কেট সার্ভে করে ইমিডিয়েটলি একটা অ্যাকশনে (বাজার জরিপ করে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে) যেতে বলা হয়েছে। কেন চালের দাম বাড়বে? তাই কোথায় কে চাল মজুত করে এবং আমাদের কিছু ইনফরমেশন আছে যে, আমি যে ইন্ডাস্ট্রিটা করব বা যে প্রোডাকশনে যাব, আমার তো মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন আছে। মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশনে তো বলা আছে, আমি কী করতে পারব?’
আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, আমাদের মনে হচ্ছে, এমন হতে পারেÑ কেউ কেউ হয়তো মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন ভেঙে চালের ব্যবসায় নেমে গেছে। এজন্য বাজার শক্তভাবে মনিটর ও সুপারভিশন করে যদি কেউ এভাবে গিয়ে থাকে… আবার ধরেন বড় একটা কোম্পানি হাজার হাজার কোটি টাকা আছে, আমি মার্কেটে নেমে এসে ধান ও চাল কিনে ফেললাম, মজুত করলাম। এগুলো আমি কতদিন রাখতে পারব। এগুলো সুপারভিশন করে কুইকলি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, কিছুদিন আগে তেলের বিপরীতে যেভাবে ড্রাইভ দেওয়া হলো, ওই রকম ড্রাইভ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। যদি কেউ এভাবে আন-অথরাইজড চালের ব্যবসা করে বা মজুত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আজ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আর একটা জিনিস বলা হয়েছে, বেশিরভাগ দেশেই মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন স্পেসিফিক একটা বিষয়ের ওপর থাকে। কিন্তু আমাদের এখানে দেখা যাচ্ছে, একটা মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে অনেকগুলো ঢুকিয়ে দেয়। তাই এটাও শক্তভাবে দেখতে বলা হয়েছে। কার মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন ও আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশনে কি আছে? সে কি পণ্যের উৎপাদন বা ব্যবসা করবে এবং এর বাইরে যাচ্ছে কি-না। প্রয়োজন হলে তাকে সতর্ক করা যেতে পারে।’
তিনি বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তারা অন্যান্য দেশ থেকে দ্রুত তথ্যটা নেবে, তারা যে মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন এবং আর্টিকেল অব অ্যাসোসিয়েশন দেয়, সেটা আইটেম বা বিজনেস ওরিয়েন্টেড কি-না। সেই বিজনেসের বাইরে সে অন্যটা করতে পারে কি-না। উন্নত দেশে একটির মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন দিয়ে আরেক ব্যবসা করা যায় না। এটা হয়তো তারা জানেও না, সেটাও হতে পারে।’
এদিকে সেনাসদর দফতরের মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে ‘আর্মি সিলেকশন বোর্ড-২০২২’-এর বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি দিয়ে তার প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের এই একটি সিদ্ধান্তÑ বিশ্বের দরবারে দেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করার পাশপাশি জাতির আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে দিয়েছে। সেনা সদর দফতরের মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে আর্মি সিলেকশন বোর্ড ২০২২-এর বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।
তিনি বলেন, জনৈক ব্যক্তি পদ্মা সেতু প্রকল্পে মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ আনায় কোনো বোর্ড মিটিং না করেই বিশ্বব্যাংক সেতুটি নির্মাণে অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। যদিও পরে ওই অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণিত হয়। আমরা যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছি, (বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি অর্জন করেছে) তা নিয়ে আমাদের আত্মবিশ্বাসের সাথে এগিয়ে যেত হবে। সেনাবাহিনীর বিভিন্ন জাতি গঠনমূলক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বাংলাদেশ আর্মি সব সময়ই অবকাঠামো নির্মাণসহ দেশের সার্বিক উন্নয়নে অবদান রেখে গেছে। প্রধানমন্ত্রী তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে জনগণের আত্মবিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করতে সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, কোভিড-১৯ মহামারিতে সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিজিবিসহ সবাই জনগণের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজন সংক্রান্ত সরকারি পদক্ষেপ সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা জলবায়ু উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিতে কক্সবাজারের খুরুসকুলে ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছেন। তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন যে, সারা দেশে কেউ ভূমিহীন এবং গৃহহীন থাকবে না, কারণ তার সরকার বিনামূল্যে জমি দিয়ে বাড়ি করে দিচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বে বাংলাদেশই একমাত্র উদাহরণ যেখান থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গতিশীল নেতৃত্বে তিন মাসের মধ্যে মিত্রবাহিনী তাদের দেশে ফিরে গেছে। তৎকালীন পূর্ব (বর্তমানে বাংলাদেশ) এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রতিটি সেক্টরে বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে বৈষম্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পাকিস্তানি সামরিক সার্ভিসে শুধু একজন কর্নেল ছিলেন। তিনি বলেন, এখন জেনারেলরা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আছেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে নেতৃত্বের জন্য পেশাদারি দক্ষতা, উৎকর্ষ, সততা ও দেশপ্রেম সম্পন্ন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিতে হবে। আপনাকে মনে রাখতে হবে, নিরপেক্ষ মূল্যায়নের মাধ্যমে পেশাদারভাবে দক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন করা সম্ভব এবং আপনাকে পদোন্নতির জন্য উচ্চ নৈতিক চরিত্রের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে বলেন প্রধানমন্ত্রী। দায়িত্ব প্রাপ্তরা সততা, ন্যায়পরায়ণতা এবং ন্যায়বিচারের সাথে দায়িত্ব পালন করবেন বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আনুগত্যসহ নেতৃত্বের জন্য দৃঢ় মানসিকতা, সততা এবং অন্যান্য গুণাবলীসম্পন্ন কর্মকর্তারা উচ্চতর পদোন্নতির জন্য যোগ্য। যাদের সামরিক জীবনে সফল নেতৃত্বের রেকর্ড রয়েছে এমন অফিসারদের পদোন্নতির জন্য বিবেচনা করা উচিত। সেনাবাহিনীর সদস্যরা সর্বদা জনগণের পাশে থাকে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে বিশ্বব্যাপী দেশের ভাবমর্যাদা উজ্জ্বল করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পরপরই একটি উন্নত, পেশাদার ও প্রশিক্ষিত বাহিনী গড়ে তুলতে ১৯৭২ সালে কুমিল্লায় মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে প্রতিরক্ষা নীতি প্রণয়ন করেন, উল্লেখ করে তিনি বলেন, তার সরকার বঙ্গবন্ধুর প্রতিরক্ষা নীতি অনুসরণ করে ‘ফোর্সেস গোল-২০৩০’ প্রণয়নের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন অব্যাহত রেখেছে।
প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব:) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন।