দেশের দক্ষিণের তিলোত্তমা মহানগরী খুলনা এখন আর তিলোত্তমা নেই। বিভাগীয় শহর খুলনার সব সৌন্দর্যকে মøান করে দিয়েছে খানাখন্দে ভরা সড়ক। অধিকাংশ সড়ক ব্যবহার করার মত নয়। সড়ক ও ড্রেন সংস্কারের মেগা প্রজেক্টে গত ৪ বছরে দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি)। অন্যদিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগ বাস্তবায়ন করছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প।
দায়সারা কাজ করার ফলে সড়কগুলো তার পুরনো চেহারায় ফিরে গেছে। আর কয়েকদিন পর শুরু হচ্ছে বর্ষ মৌসুম। কিন্তু তার আগেই সামান্য বৃষ্টিতে খুলনা মহানগর হাটু সমান পানিতে তলিয়ে যায়। ড্রেনের উপচেপড়া ময়লা পানি বৃষ্টির জমে থাকা পানির সাথে মিশে পরিস্থিতিকে দুর্বিষহ করে তুলে।
এদিকে প্রয়োজনীয় বরাদ্দের অভাব এবং নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিতে ঠিকাদাররা কাজ করতে অনীহার প্রকাশ করলে মাঝপথে বন্ধ হয়ে গেছে মহানগীরর ৬১টি সড়কের কাজ। বিভিন্ন মহল দ্রুত সড়কগুলো সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদান ও বিক্ষোভ সমাবেশ করলেও কর্তৃপক্ষ নিশ্চুপ।
খুলনা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ মুজগুন্নি মহাসড়ক অসংখ্য খানাখন্দে ভরা। কোথাও বিটুমিন-ইট উঠে বড় বড় গর্ত হয়েছে। এ অবস্থায় গর্ত পাশ কাটিয়ে ঝুঁঁকি নিয়ে যানবাহন চলছে। বৃষ্টিতে গর্তগুলো তলিয়ে যায়। ফলে লোক ও যানবাহন চলাচলে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। মহানগরীর সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনাল থেকে বয়রা বাজার হয়ে নতুন রাস্তা পর্যন্ত ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কটির সর্বশেষ সংস্কার হয়েছিলো ২০১২ সালে। এক যুগের বেশি সময় ধরে সংস্কারের অভাবে সড়ক আর ব্যবহারের পর্যায়ে নেই।
খুলনা মহানগরীর শান্তিধাম মোড় থেকে দেড় কিলোমিটার শামসুর রহমান রোডের কাজ শুরু হয়েছিল প্রায় দুই বছর আগে। রাস্তার পাশে ড্রেন ও ফুটপাথের কাজ প্রায় শেষ হলেও সড়কের কাজ শেষ হয়নি। গোয়ালখালি মোড়ের রাস্তা গত ৫ বছরেও সংস্কার হয়নি। সড়কের একদিকে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অফিস, অন্যদিকে খুলনা সিটি করপোরেশন। সড়ক ও জনপথ এবং কেসিসির ঠেলাঠেলিতে কপাল পুড়েছে সাধারণ মানুষের।
খুলনার খালিশপুর শিল্পাঞ্চলের প্রধান সড়ক বিআইডিসি থেকে আলমনগর মোড় পার হলেই যাত্রীদের নাগরদোলায় দুলতে হয়। দুই কিলোমিটার রাস্তার শতকরা ৭০ ভাগই খানাখন্দে ভরা। খুলনা ওয়াসা ৪ বছর আগে রাস্তা কেটে পাইপ বসানোর পর সংস্কার না করায় মাঝের অংশ গর্ত হয়ে আছে পুরো বিআইডিসি সড়ক জুড়ে।
খুলনার গুরুত্বপূর্ণ শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তের কাজ ৯ বছর ধরে ঝুলে আছে। রূপসা শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্তের কাজ শুরু করার নামে ২০১৩ সালে শুধুমাত্র জমি অধিগ্রহণ ছাড়া কিছুই হয়নি। নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্প ব্যয় ৯৯ কোটি টাকার স্থলে বাড়িয়ে ২৫৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা করা হয়েছে। এরপরও টেন্ডার কার্যক্রম শেষ না হওয়ায় সড়কে চলাচলকারীদের দুর্ভোগ কবে শেষ হবে তা কেউই বলতে পারছে না।
২০২০ সালে শুরু হওয়া খুলনা মহানগরীতে ৪ কিলোমিটার সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ চলতি বছরের ৭ এপ্রিল শেষ হওয়ার নির্দিষ্ট সময় ছিল। খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ চলতি মাসের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় বৃদ্ধি করলেও গত মে মাস পর্যন্ত কাজ হয়েছে মাত্র ৬৫ শতাংশ। প্রকল্পে নতুন কিছু কাজ অন্তর্ভুক্তিতে ব্যয় ও বাস্তবায়নের সময় আরও বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আনিসুজ্জামান মাসুদ।
মহানগরীর বাইর খুলনা-চুকনগর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের খুলনা শহরাংশ (৪ কি.মি.) চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ গত ৭ এপ্রিল শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এখনো পুরো কাজ সম্পন্ন হয়নি। ডুমুুরিয়ার কাঁঠালতলা-কপিলমুনি হয়ে মাগুরখালী পাকা সড়কের একই দশা। গত ৬ বছর সংস্কার না করায় অধিকাংশ জায়গায় সৃষ্টি হয়েছে ছোট-বড় গর্ত। ডুমুরিয়া উপজেলা প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার দাস জানান, সড়ক প্রশস্ত ও পুনঃসংস্কারের লক্ষ্যে প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। অনুমোদন পেলে দ্রুত সড়ক সংস্কারের কাজ করা সম্ভব হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরাদ্দের অভাবে খুলনার অনেক সড়কের কাজ শুরু হয়েও শেষ হয়নি। দাফতরিক প্রক্রিয়াগত নানা কারণেও জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। খুলনা মহানগরীর জোড়াকল বাজার থেকে সাহেবখালী খাল পর্যন্ত ড্রেনসহ ফুটপাত নির্মাণের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয় গত বছরের ৮ জুন। এরপর গত ২৪ জানুয়ারি দ্বিতীয়বার ও ২৩ ফেব্রুয়ারি তৃতীয়বার দরপত্র আহ্বান করা হয়। একবারও দরপত্র জমা পড়েনি। বর্তমানে চতুর্থ দফা দরপত্র আহ্বানের প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া সোনাডাঙ্গা আবাসিক এলাকায় সোলার পাকের পাশে ড্রেন নির্মাণের জন্য দুই দফা দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
শুধু ওই দুটি কাজই নয়, গত কয়েক মাসে বিভিন্ন স্থানে ড্রেন নির্মাণ ও সড়ক সংস্কারের জন্য ৯টি দরপত্রে কোনো ঠিকাদার অংশ নেননি। কেসিরি খাল খনন ও ড্রেন সংস্কারের জন্য ১৬টি দরপত্রে নিয়মিত ঠিকাদাররা অংশ নেননি। মহানগরীর ৩১টি ওয়ার্ডে ৬১টি সড়ক ও ড্রেনের সংস্কারকাজ চললেও নির্মাণসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় এসব কাজে গতি কমেছে। অনেকে মাঝপথে কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। বর্তমানে প্রায় হাজার কোটি টাকার কাজ বন্ধ রয়েছে। এতে দুর্ভোগ বেড়েছে মহানগরবাসীদের।
ঠিকাদাররা জানান, গত কয়েক মাসে নির্মাণসামগ্রীর দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। সে তুলনায় কেসিসির শিডিউল দর অনেক কম। কাজ করে প্রত্যেকের বিপুল অঙ্কের লোকসান হচ্ছে। আবার বেশি দাম দিয়েও পাথর পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য বাধ্য হয়ে অনেকে কাজ বন্ধ রেখেছেন। নিশ্চিত লোকসান জেনে দরপত্রে কেউ অংশ নিচ্ছেন না।
কেসিসির পূর্ত বিভাগ থেকে জানা গেছে, বর্তমানে মহানগরীতে ৮২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পানিবদ্ধতা দূরীকরণে ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং ৬০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে রাস্তা উন্নয়ন ও পুনর্বাসন প্রকল্পের কাজ চলছে। এর মধ্যে রাস্তা সংস্কার প্রকল্পের আওতায় ৩১টি ওয়ার্ডে প্রায় ৩২২ কোটি টাকার কাজ চলছে। পানিবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে ১২৮ কোটি টাকার কাজ চলছে। নতুন দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে আরও ১০০ কোটি টাকার। এছাড়া সড়ক বিভাগ, কেডিএ, গণপূর্ত বিভাগের আরও ৫০০ কোটি টাকার কাজ চলছে।
কেসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী লিয়াকত আলী খান বলেন, খুলনার সড়ক ও ড্রেন উন্নয়ন ও সংস্কারে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে। যত দ্রুত সম্ভব কাজগুলো শেষ করার চেষ্টা আমরা করছি। সড়কে কাজ চলায় নগরবাসীর কিছুটা সমস্যা অবশ্যই হচ্ছে। তবে এটি সাময়িক।
কেসিসি মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক বলেন, নির্মাণ কাজে সরকারি দর বাড়াতে হলে প্রকল্প সংশোধন করতে হবে। বিষয়টি স্থানীয় সরকারমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। মন্ত্রীর সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত কিছুই করা যাচ্ছে না।