দীর্ঘ প্রায় ১১ বছর ধরেই আলোচনা চলছে শিক্ষা আইন নিয়ে। নানা আলোচনা, সংশোধন, পুনঃসংশোধনের পর অবশেষে আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে শিক্ষা আইন। আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রস্তাবিত এই আইনের ৫৭টি ধারা দিয়ে পরিচালিত হবে শিক্ষাব্যবস্থা।
আইনে নোট-গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত নিষিদ্ধ রাখা হচ্ছে। তবে সরকারের অনুমোদন নিয়ে সহায়ক পুস্তক, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে। একইভাবে নিবন্ধন নিয়ে কোচিং চালানোর সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাসের সময় এবং নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কোচিং করাতে পারবেন না শিক্ষকরা।
খসড় আইন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আইনে নোট-গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত নিষিদ্ধ রাখা হচ্ছে। কেউ এই বিধান লঙ্ঘন করলে তিন বছর জেল বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোন শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে নোট বা গাইড বই কিনতে বা পড়তে বাধ্য বা উৎসাহিত করতে পারবেন না। করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান, ব্যবস্থাপনা কমিটি বা পরিচালনা কমিটির সংশ্লিষ্ট সদস্যের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক এক্তিয়ারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। তবে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সহায়ক পুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে। কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের তা কিনতে বা পড়তে বাধ্য বা উৎসাহিত করতে পারবেন না। করলে তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।
কোচিং, প্রাইভেট টিউশনের বিষয়ে বলা হয়েছে, কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক তার নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট টিউশনে পড়াতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের সনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের লিখিত সম্মতি সাপেক্ষে স্কুল সময়ের পরে বা আগে সরকার প্রণীতি বিধি বা নীতিমালা, আদেশ অনুসরণ করে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে। কোন শিক্ষক তার নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে ইলেকট্রনিক বা অনলাইন পদ্ধতিতেও প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংয়ের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না, করলে শাস্তিযোগ্য হবে।
প্রাইভেট টিউশনের উদ্দেশ্যে কোটিং সেন্টার পরিচালনা করা বা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা এই আইনে নিষিদ্ধ হবে না। তবে কোচিংয়ের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস চলাকালীন সময়ে কোচিং কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
তবে শিক্ষাবিদেরা মনে করছেন, এটি বাস্তবায়ন করা দুরূহ হবে। কারণ, সারা দেশে অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; সেখানে কে কাকে পড়াচ্ছেন সেটি দেখবেন কে?
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন, কোচিং বন্ধ হবে না। তবে কোচিংকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। কোচিংয়ের অনৈতিক দিকগুলো বন্ধ করা দরকার। প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের খসড়ায় শিক্ষক কাকে, কোথায় পড়াতে পারবেন, সেই বিষয়গুলো বলা হয়েছে।
আইনে আরও বলা হয়েছে- সরকার অনুমোদিত বাংলা, ইংরেজি মাধ্যমসহ বিদেশী শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পরিচালিত সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন, টিউশন ও অন্যান্য ফি আদায়ের ক্ষেত্রে অযৌক্তিকভাবে উচ্চহারে আদায় করা হলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।
প্রাথমিক পর্যায়ের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রা-প্রাথমিক স্তর থাকতে হবে। ১ম থেকে ৫ম পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর, ষষ্ঠ থেকে দশম মাধ্যমিক, একাদশ থেকে দ্বাদশ উচ্চ মাধ্যমিক স্তর। মাধ্যমিক স্তরে তিনটি ধারা থাকবে- সাধারণ শিক্ষা, মাদরাসা শিক্ষা এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা। সকল স্তরে সরকার নির্ধারিত জাতীয় শিক্ষাক্রম বাধ্যতামূলক হবে। বিদেশি শিক্ষাক্রমের আওতায় পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাক্রমে সরকার নির্ধারিত বিষয়সমূহ বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর কোন ব্যত্যয় হলে সরকার সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্ব স্ব সংস্কৃতির পরিপন্থি এবং কোন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কোন কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিষয়ে বলা হয়েছে- সরকারের অনুমতি ব্যতিরেকে কোন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। কোন এলাকায় কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার প্রয়োজন নেই বলে সরকারের কাছে প্রতীয়মান হলে সরকার তা পার্শ্ববর্তী অন্য কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাথে একীভূত, স্থানান্তর বা বিলুপ্ত করতে পারবে। সরকারের অনুমতিপ্রাপ্ত নূতন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনার জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক হবে এবং বিদেশি শিক্ষাক্রমে পরিচালিত স্কুল, কিন্ডারগার্টেন মাদরাসা স্থাপন ও পরিচালনা অথবা বিদেশি কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে শাখা স্থাপন বা পরিচালনার ক্ষেত্রেও একই শর্ত প্রযোজ্য হবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটির ক্ষেত্রে বলা হয়, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি বা পরিচালনা কমিটি বা এর চেয়ারম্যান/সভাপতি নির্ধারিত এক্তিয়ারের বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দৈনন্দিন প্রশাসনে বা পাঠদানে হস্তক্ষেপ করবেন না। তার হস্তক্ষেপের কারণে কোন অনিয়ম বা পাঠদান বাধাগ্রস্ত হলে কমিটি সার্বিকভাবে বা ক্ষেত্রমতে চেয়ারম্যান/সভাপতি দায়ী হবেন। নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ উক্ত কমিটি বাতিল বা চেয়ারম্যান/সভাপতিকে অপসারণ করতে পারবে।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেন, কোচিং-প্রাইভেট একেবারে বন্ধ করা যাবে না। কারণ, কিছু শিক্ষার্থী থাকে অন্যান্য শিক্ষার্থীর চেয়ে তুলনামূলক দুর্বল। আবার সব শিক্ষার্থীর মা-বাবার পক্ষেও পড়াশোনার বিষয়ে সন্তানকে প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে তারা কোচিং-প্রাইভেট পড়তেই পারে। তবে অনেক শিক্ষক ক্লাসে ঠিকমতো না পড়িয়ে তাঁদের কাছে শিক্ষার্থীদের কোচিং-প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করেন। এটিকেই তাঁরা বন্ধ করতে চান।
সহায়ক বইয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, সহায়ক বই থাকতেই পারে। তবে সেটি কিনতে বা পড়তে বাধ্য করা যাবে না, সেটি আইনে রয়েছে।