নির্ধারিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ব্যর্থ হয়েছে। ফলে অনির্দিষ্টকালের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন চা শ্রমিকরা। তবে আজ বুধবার ঢাকা শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে বাগান মালিকপক্ষ ও চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দের নিয়ে আলোচনায় বসবে বাংলাদেশ শ্রম অধিদফতর। এদিকে চা শ্রমিকদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে মানববন্ধন করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। অপরদিকে চুনারুঘাটের পারকুল ও নাছিমাবাদ চা বাগানে চা শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির দাবিতে পারকুল চা বাগান পঞ্চায়েত কমিটির উদ্যোগে পারকুল চা বাগানের নাচঘর প্রাঙ্গণে দু’ বাগানের যৌথ সমাবেশ ও অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করেছে পারকুল ও নাছিমাবাদ বাগানের চা শ্রমিকরা। সিলেট থেকে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্যে প্রতিবেদন।
গতকাল মঙ্গলবার মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে শ্রম অধিদফতরের আঞ্চলিক কার্যালয়ে চা শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে শ্রম অধিদফতর কর্তৃপক্ষের দুই দফা বৈঠক হয়। বৈঠকে আগামী ২৩ আগস্ট পর্যন্ত আন্দোলন কর্মসূচি স্থগিত করার আহ্বান জানান শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী এনডিসি। কিন্তু কোনো বাগানের মালিকপক্ষ বৈঠকে উপস্থিত না হওয়ায় মহাপরিচালকের কথা রাখেননি চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ। ফের বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য শ্রমিক নেতৃবৃন্দকে ১ ঘণ্টা সময় দিয়ে প্রাথমিকভাবে বৈঠক শেষ করেন শ্রম অধিদফতরের কর্মকর্তারা। কিন্তু বিকেলে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় দফা বৈঠকেও চা শ্রমিক নেতারা তাদের অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতে চালিয়ে যাবেন বলে ঘোষণা দেন। এঅবস্থায় সমাধান ছাড়াই শেষ হয় শ্রম অধিদফতর ও চা শ্রমিকদের বৈঠক।
এদিকে শ্রমিক ধর্মঘটে গত আট দিন ধরে সারা দেশের বাগান থেকে চা পাতা উত্তোলন, কারখানায় প্রক্রিয়াজাত ও উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের সম্ভাবনাময়ী আদি খাত চা শিল্প। এখন চা উৎপাদনের মৌসুম। গত কয়েকদিনে গাছে গাছে সবুজ পাতা আর কুঁড়ি অঙ্কুরিত হয়েছে। ফ্যাক্টরিতে নিয়ে এসব পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণের ঠিক এই সময়ে স্থবির হয়ে পড়েছে চা শিল্পের যাবতীয় কর্মযজ্ঞ। এতে কোটি কোটি টাকা লোকসান হবে সরকারের।
বৈঠকে উপস্থিত থাকা বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা বলেন, গতকাল বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আমাদের একটাই দাবি ছিলো- দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করা। কিন্তু আজকের বৈঠকেও মালিকপক্ষ কেউ ছিলেন না। আমাদের দাবিও মানা হয়নি। তাই আন্দোলন অব্যাহত রাখবো আমরা।
মৌলভীবাজার জেলা সংবাদদাতা জানান, মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানসহ দেশের ১৬৭টি চা বাগানে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে। এদিকে শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করতে গতকাল শ্রীমঙ্গলের শ্রম অধিদফতরে আসেন শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী। এ সময় তিনি আন্দোলন স্থগিত করে আলোচনায় বসার আহ্বান জানালে চা শ্রমিক ইউনিয়ন তা প্রত্যাখান করে আন্দোলন চালিয়ে যাবার ঘোষণা দেয়। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে শ্রম দফতরের কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে এ আলোচনা শুরু হয়।
এতে উপস্থিত ছিলেন, বিভাগীয় শ্রম দফতর শ্রীমঙ্গলের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুর রহমান, বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরাসহ ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল।
বৈঠক শেষে বাংলাদেশ শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক ধর্মঘট প্রত্যাহারে চা শ্রমিক নেতাদের অনুরোধ করেন জানান। তিনি বলেন, চায়ের এই ভরা মৌসুমে প্রতিদিন ৮ কোটি টাকা লোকসান হচ্ছে চা বাগান মালিকদের। দৈনিক ৩০০ টাকা মজুরির বিষয়ে তিনি বাগান মালিকদের সঙ্গে আগামী ২৩ আগস্ট ঢাকায় মন্ত্রী ও সচিবের নেতৃত্বে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে চা শ্রমিকদের মজুরির বিষয়ে কথা বলবেন।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিপেন পাল ও কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরা বলেন জানান, আন্দোলন তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সেখান থেকে মজুরি বৃদ্ধির ঘোষণা আসা ছাড়া ফেরা সম্ভব নয়। শুধু তারা শোকের মাসের কথা বিবেচনা করে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত রাজপথ অবরোধে চা শ্রমিকরা যাবেনা। তবে বাগানের ভেতরে অন্যান্য কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। চলমান আন্দোলনের মধ্যে সর্বশেষ গত সোমবার প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি প্রদান করেছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের বালিশিরাসহ বিভিন্ন ভ্যালীর চা শ্রমিক নেতারা। কর্মসূচি অনুযায়ী সারাদেশে আমাদের যৌক্তিক আন্দোলন চলছে।
উল্লেখ্য, শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবিতে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন গত ৯ আগস্ট থেকে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ২ ঘণ্টা ও পরে ১৩ আগস্ট পূর্ণ ধর্মঘট পালন করেন চা শ্রমিকরা। ১৪ ও ১৫ আগস্ট ২ দিন স্থগিত থাকার পর গতকাল মঙ্গলবার আবার ধর্মঘট পালন করে। দেশের ১৬৭টি চাবাগানের ন্যায় মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানের শ্রমিকরা অংশ নিচ্ছে এই ধর্মঘটে।
শাবি সংবাদদাতা জানান, চা শ্রমিকদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা পোষণ করে মানববন্ধন করেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। এসময় চা শ্রমিকদের বর্তমানে ১২০ টাকা মজুরি প্রদানকে একধরণের জুলুম বলে আখ্যা দিয়েছেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে মানববন্ধনে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক কিন এর প্রেসিডেন্ট ইফরাতুল হাসান রাহিমের সঞ্চালনায় বক্তারা বলেন, চা শ্রমিকরা আমাদের সমাজের একটা অংশ যারা আমাদের অর্থনীতিতে অনেক বড় যোগান দিয়ে থাকে। দ্রব্যমূল্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার আগে থেকেই তাদের মজুরি ধীরে ধীরে ৭০-৮০ থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত বাড়াতে প্রায় ৫০ বছর লেগে গেছে। এই মুহুর্তে তাদেরকে ১২০ টাকা মজুরি প্রদান করা সম্পূর্ণরূপে একটা জুলুম। একটি মহল এখান থেকে সুবিধা নিচ্ছে। সরকার চাইলেই এই সমস্যার সমাধান করতে পারে।
শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, বাংলাদেশ চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে আলোচনায় বসেছিলেন বাংলাদেশ শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক খালেদ মামুন চৌধুরী। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে বিভাগীয় শ্রম দফতরের কার্যালয়ের কনফারেন্স রুমে এই আলোচনা শুরু হয়। এতে শ্রম অধিদফতর শ্রীমঙ্গল উপ-পরিচালক মো. নাহিদুল ইসলাম, মৌলভীবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোছাম্মৎ শাহীনা আক্তার, হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাদিকুর রহমান, হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শৈলেন চাকমা, শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলী রাজীব মাহমুদ মিঠুন, সহকারী পুলিশ সুপার মো. শহিদুল হক মুন্সি, চা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাখন লাল কর্মকার, সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নৃপেন পাল, সিলেট ভ্যালি সভাপতি রাজু গোয়ালা, প্রমুখ বৈঠকে অংশ নেন।
চা শ্রমিক নেতাদের আলোচনা শেষে মহাপরিচালক চা শ্রমিক নেতাদের আহ্বান করেন আগামী ২৩ আগস্ট পর্যন্ত সকল আন্দোলন স্থগিত রাখার অনুরোধ করেন। মহাপরিচালক বলেন, আমরা মালিকপক্ষকে নিয়ে আগামী ২৩ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে শ্রমিকদের সকল যৌক্তিক দাবি দাওয়া নেওযার নেওয়ার লক্ষ্যে বসবো। আমি আপনাদের দাবি দাওয়ার বিষয়টি মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট পেশ করবো। মহাপরিচালকের এমন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে সেøাগান দিতে দিতে হল রুম থেকে চা শ্রমিক নেতাদের একটি অংশ বের হয়ে যান। সিলেট ও চট্টগ্রামসহ দেশের ৭টি ভ্যালির ১৬৬টি চা বাগানের ২৩১টি ফাঁড়ি বাগানের চা শ্রমিকরা কঠোর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছেন। হল রুমে চা শ্রমিকদের সেøাগানে উত্তাল হওয়ায় ১ ঘণ্টা পরে আবার শ্রমিক নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসার আহ্বান করেন শ্রম অধিদফতরের ডিজি খালেদ মামুন চৌধুরী। পরে সন্ধ্যা ৬টায় মহাপরিচালকের সঙ্গে চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ আবারো আলোচনায় বসেন, সেই আলোচনায় কোন সিদ্ধান্তে হয়নি। আজ বুধবার ঢাকা শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে বাগান মালিকপক্ষ ও চা শ্রমিক নেতৃবৃন্দের নিয়ে আলোচনায় বসবে বাংলাদেশ শ্রম অধিদফতর। এদিকে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা জানান, আমরা আন্দোলন স্থগিত করবো না। আন্দোলনও চলবে আলোচনাও চলবে।
চুনারুঘাট (হবিগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, চুনারুঘাটের পারকুল ও নাছিমাবাদ চা বাগানে চা শ্রমিকদের মজুরী বৃদ্ধির দাবিতে পারকুল চা বাগান পঞ্চায়েত কমিটির উদ্যোগে গত মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় পারকুল চা বাগানের নাচঘর প্রাঙ্গণে দু’ বাগানের যৌথ সমাবেশ ও অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করেছে পারকুল ও নাছিমাবাদ বাগানের চা শ্রমিকরা।
পারকুল বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সাবেক সভাপতি ও সাবেক মেম্বার গিরিধারী চৌহানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে অন্যান্যদের মাঝে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন- সাবেক ছাত্র ও যুবনেতা বর্তমান ৯নং রানীগাঁও ইউনিয়ন আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিক ফারুক মাহমুদ, সাবেক রানীগাঁও ইউনিয়ন ছাত্রলীগ নেতা ও বর্তমান ৯নং ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পারকুল বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি রিপন দেব তপন, শ্রমিক নেত্রী নমিতা বুনার্জী, শ্রমিক নেতা অনিল তাঁতী প্রমুখ।তারা পারকুল নাচঘর প্রাঙ্গণ হতে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করে নাছিমা চা বাগান অফিস প্রাঙ্গণে এসে ধর্মঘটে মিলিত হন।