সদ্য সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দরে রেকর্ড ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় এক লাখ ৫৮ হাজার ৯৫টি বেশি। একই সময়ে দেশের এই প্রধান সমুদ্র বন্দরে কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৭৪ হাজার ১৬০ মেট্রিক টন। এ সময় জাহাজে হ্যান্ডলিং হয়েছে চার হাজার ২৩১টি। কন্টেইনার, কার্গো এবং জাহাজ হ্যান্ডলিং-তিনটি খাতেই প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এদিকে করোনা, ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যে মন্দাবস্থার মধ্যেও চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়েছে। দেশের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আহরণকারী এই প্রতিষ্ঠানটি রাজস্ব আদায়ে ৬০ হাজার কোটি টাকার মাইলফলক অতিক্রম করেছে। ৩০ জুন পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ৫৯ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। আর সরকারি-বেসকারি সাতটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া তিন হাজার ৮৮৪.৪৩ কোটি টাকাসহ রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ১৪০ কোটি টাকা। বকেয়াসহ রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি ২২.৪২ শতাংশ।
দেশের অর্থনীতির মুল চালিকা শক্তি চট্টগ্রাম বন্দর সার্বক্ষণিক সচল থাকায় আমদানি-রফতানি গতিশীল হয়েছে। সেই সাথে বেড়েছে রাজস্ব আহরণ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক গতকাল শুক্রবার দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ছে। তার সাথে সাথে বাড়ছে কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিং। গেল অর্থবছরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে ৫.১ শতাংশ. কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে ৩.৯ শতাংশ এবং জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ে ৪.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের রেকর্ড থেকে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩২ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৮ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩০ লাখ ৯৭ হাজার ২৬৩ টিইইউএস। কার্গো হ্যান্ডলিং হয়েছে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৭৪ হাজার ১৬০ মেট্রিক টন। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৩৭ লাখ ২৯ হাজার ৩৭৩ মেট্রিক টন। গেল অর্থবছরে জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে চার হাজার ২৩১টি। আগের অর্থবছরে জাহাজের সংখ্যা ছিল চার হাজার ৬২টি। বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, গত কয়েক বছরে বন্দরে নতুন নতুন যন্ত্রপাতি যোগ হয়েছে। সম্প্রসারণ করা হয়েছে জেটি ইয়ার্ড। তাতে বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে। এর ফলে বন্দরের সার্বিক কর্মকাণ্ড আরো বেশি গতিশীল হচ্ছে।
বন্দরের সক্ষমতায় রাজস্ব আহরণে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে কাস্টম হাউস ৫৯ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছে। লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৪ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। এর আগের অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ৫১ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা না গেলেও লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরভিত্তিক এই রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান।
গেল অর্থ বছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছিল ৬৪ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯৩৫ কোটি টাকা কম আদায় হয়েছে। তবে আগের অর্থ বছরের তুলনায় বকেয়াসহ ১১ হাজার ৫৬৪ কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। আর এতে রাজস্ব আহরণে প্রবৃদ্ধি ২২ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
করোনার ধকল কাটিয়ে উঠার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এর প্রভাবে অভ্যন্তরীণ আমদানি কমে যায়। সরকারও অর্থ বছরের শেষের দিকে উচ্চ বিলাসী পণ্যের আমদানির লাগাম টেনে ধরে। আবার দেশে ভোক্তাদের সুবিধা দিতে বেশকিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়ে দেয়। এসব কারণে রাজস্ব আদায়ে কিছুটা টান পড়ে। আর তা না হলে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করা যেত বলে মনে করেন কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, অর্থ বছরের শুরু থেকে মিথ্যা ঘোষণায় রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধসহ রাজস্ব আহরণে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। বাড়ানো হয় নজরদারি। এতে রাজস্ব আহরণে শুরু থেকেই গতি আসে। বিশেষ করে মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি কমে যাওয়া এবং মিথ্যা ঘোষণা আটক পণ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকের শুল্ক কর ফাঁকর দ্বিগুণ জরিমানার ফলে রাজস্ব আদায় বাড়তে থাকে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দিক নির্দেশনা অনুযায়ী কাস্টমস হাউসের কার্যক্রম সার্বক্ষণিক সচল রাখা হয়। আমাদানিকারকদের জন্য হয়রানিমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়। তাতে রাজস্ব আহরণ সহজতর হয়েছে।
কাস্টমসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬৪ হাজার ৭৫ কোটি টাকা। মাসভিত্তিক হিসেবে অর্থবছরের জুলাই মাসে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় চার হাজার ৯৮১ কোটি টাকা, আগস্ট মাসে পাঁচ হাজার ২৯৯ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বর মাসে চার হাজার ৪৫১ কোটি টাকা, অক্টোবর মাসে পাঁচ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা, নভেম্বর মাসে ছয় হাজার ৩৭ কোটি টাকা, ডিসেম্বর মাসে পাঁচ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা, জানুয়ারি মাসে পাঁচ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা, ফেব্রুয়ারি মাসে চার হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা, মার্চ মাসে পাঁচ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা, এপ্রিল মাসে ছয় হাজার ৩২৬ কোটি টাকা, মে মাসে ছয় হাজার ২০০ কোটি টাকা এবং জুন মাসে পাঁচ হাজার ১৩২ কোটি টাকা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়।
৩০ জুন পর্যন্ত আদায় হয়েছে ৫৯ হাজার ২৫৬ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে আদায় হয়েছিল ৫১ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সাতটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বকেয়া পাওনা আছে তিন হাজার ৮৮৪ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে পেট্রোবাংলার কাছেই তিন হাজার ৬৯৯ কোটি ২৮ লাখ টাকা। পদ্মা অয়েল কোম্পানির কাছে ১১৬ কোটি ৭৩ লাখ, মেঘনা পেট্রোলিয়ামের কাছে ২৮ কোটি ৪০ লাখ, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলের কাছে ৫৭ লাখ, সামিট এলএনজির কাছে পাঁচ কোটি ১১ লাখ, এক্সিলারেট এনার্জির কাছে ১৩ লাখ ও বাংলাদেশ পুলিশের কাছে ৩৪ কোটি ২১ লাখ টাকা বকেয়া রয়েছে। এসব বকেয়া খুব শিগগির আদায় করা যাবে বলে আশাবাদি কাস্টমস কর্মকর্তারা।