নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ওপর আস্থাহীনতার যে সংকট রয়েছে, তা দূর করতে উদ্যোগ নিতে পরামর্শ দিয়েছেন ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিকরা। তারা বলেছেন, বিগত দুটি জাতীয় নির্বাচনে ইসির ওপর আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় আস্থা ফেরাতে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের কার্যক্রম দৃশ্যমান করতে হবে। নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান ও আইন যে ক্ষমতা দিয়েছে, তা প্রয়োগ করতে হবে।
সোমবার ইসির সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়ে তারা এসব পরামর্শ দেন। তবে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণে ইসির পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে দুই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন তারা। সংলাপে কয়েকজন সাংবাদিক বলেন, নির্বাচনে কোন দল অংশ নেবে, তা তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে ইসির করণীয় কিছু নেই। অপরদিকে কয়েকজন সাংবাদিক বিএনপির আস্থা অর্জনে ইসিকে পরামর্শ দেন। তারা বলেন, সব দলের অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় না।
এমন বক্তব্যের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল সংলাপে বলেন, কে নির্বাচনে অংশ নেবে কি নেবে না, সেটা ফোর্স (জোর) করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। তবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আহ্বান করা-আপনারা আসেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। নির্বাচনে অংশ না নিলে কিন্তু গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। তিনি বলেন, সবাইকে চেষ্টা করতে হবে একটা সুন্দর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য। আমরা অর্থহীন সংলাপ করছি না।
সিইসির সভাপতিত্বে নির্বাচন ভবনে এ সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। সংলাপে চারজন নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নেন। অপরদিকে এ সংলাপে ৩৮ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও অংশ নেন ২৭ জন। সংলাপে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ, ভোটকেন্দ্রের ভেতর ও বাইরে সিসি ক্যামেরা বসানো, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান বা মহাসচিবদের নিয়ে এক টেবিলে বৈঠকের আয়োজন করা ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে ভূমিকা রাখার পরামর্শ দেন বক্তারা। এর আগে প্রিন্ট মিডিয়ার সিনিয়র সাংবাদিক, শিক্ষক ও সুশীলসমাজের প্রতিনিদের সঙ্গেও সংলাপ করেছিল ইসি।
সোমবার সংলাপে উঠে আসা পরামর্শের সারসংক্ষেপ তুলে ধরে সিইসি আরও বলেন, নির্বাচনে কেউ এলো কি এলো না, এটা আমাদের দায়িত্ব নয় কেউ কেউ বলেছেন। আপনারাই বলেছেন নির্বাচনে পক্ষ-প্রতিপক্ষ মাঠে থেকে ব্যালেন্স তৈরি করে। দলগুলো যদি তাদের লোকবল দিয়েই ভারসাম্য করতে পারে, নির্বাচনে যদি দুটি পক্ষ থাকে, তবে দুটি পক্ষকে খেলতে হবে, তাহলে নির্বাচনটা ওইদিক থেকে সহজ হয়। তিনি বলেন, স্বচ্ছতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভোটকেন্দ্রের ভেতরে ক্যামেরা ও বাইরে মনিটরে তা দেখানোর ব্যবস্থা নিয়ে কথা এসেছে। এগুলো নিয়ে আমার সহকর্মীরাও বিশ্বাস করেন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের বিচরণ যদি থাকে, তারাও রিপোর্ট করতে পারবেন। একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য এসব বিষয়ের প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি। কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমাদের সৎভাবে দায়িত্ব পালনের স্পৃহা ও চেষ্টা আছে, থাকবে। ব্যাপক অনিয়মের তথ্য আমাদের কাছে এলে, সাহস নয়, আমাদের দায়িত্ব হয়ে যাবে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার।
সংলাপে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভোটে আসা-না-আসা দলগুলোর নিজের সিদ্ধান্তের বিষয়। জামাই আদর করে কাউকে নির্বাচনে আনতে হবে না। যে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভোটে অংশ নেবে না, তাদেরকে নির্বাচন কমিশন কী করে ভোটে অংশগ্রহণ করাবেন।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, বিশ্বাসযোগ্যতার একটা সংকট রয়েছে। সেটা যদি কাটিয়ে উঠতে পারেন, তাহলে সেটা হবে আপনাদের বড় সাফল্য। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে আপনাদের ওপর আস্থা রাখতে হবে। তাহলে সবাই নির্বাচনে আসবে। পেশাজীবন থেকে অবসরে যাওয়ার পর নির্বাচন কমিশনে দায়িত্ব নেওয়া ব্যক্তিদের সফলতা প্রত্যাশা করে তিনি বলেন, এটাই আপনাদের জীবনের শেষ অ্যাসাইনমেন্ট। সেটা মনে রেখে আপনারা অনেক ভালো কাজ করবেন।
৭১ টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু বলেন, ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশন বিতর্কিত হয়েছে। কখনো কখনো দলগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ইসিকে বিতর্কিত করেছে। এটা একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আপনাদের এটার ঊর্ধ্বে থাকতে হবে। ড. শামসুল হুদা কমিশন বিএনপিকে ভাঙার জন্য মেজর হাফিজের নেতৃত্বাধীন অংশকে ধানের শীষ প্রতীক দিতে চেয়েছিল। এটিই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্যতম নির্বাচন কমিশন ছিল। কাজেই পারসেপশন একটা অদ্ভূত খেলা। তিনি বলেন, বিএনপিকে নির্বাচনে আনা বা না আনা অথবা দল ভাঙার কাজ আপানাদের না। চোখ-কান বন্ধ করে সোজা হাঁটেন। বড় দলগুলো না এলে নির্বাচন একতরফা হয়ে যায়। এর বাইরে কাউকে আনা বা না আনা আপনাদের কাজ না। তিনি বলেন, ইভিএমে পেপার টেইল চালু করা গেলে আস্থা বাড়বে।
সিনিয়র সংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, আপনাদের ভালো নির্বাচন করা ছাড়া ডানে-বাঁয়ে কিছুই নেই। সহিংসতা যাতে না হয় এবং সবাই যেন নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, আস্থার সংকট দূর করা দরকার। ইভিএমেও আস্থার সংকট দূর করতে হবে। এনআইডি যদি সংশোধন না করেন, তাহলে কিন্তু অসংখ্য মানুষের খুনের দায়ে দায়ী হবেন। কেননা অনেক জীবিত মানুষ ইসির সার্ভারে মৃত হয়ে আছে।
গ্লোবাল টিভির এডিটর ইন চিফ সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, নির্বাচন কমিশনের নিজেদের ভেতরে সংহতি এবং ঐক্য, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এছাড়া বেশকিছু নির্বাচনে অত্যন্ত সহিংস ঘটনা ঘটেছে। ওই সহিংসতা বন্ধে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা প্রয়োগের দৃঢ়তার অভাব দেখেছি। নির্বাচনি অনিয়ম হওয়ার পর গেজেট প্রকাশ না করার মনোভাবও দেখতে পাইনি। তিনি বলেন, সরকারও চায় ভালোভাবে নির্বাচন হোক, সব দলও অংশ নিক। ইসির যে ক্ষমতা আছে, আইনে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, সেই জায়গা থেকে মানুষের ভাবনার প্রতিফলিত হয়-সেটাই দেখার বিষয়।
যমুনা টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম আহমেদ বলেন, নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসাবে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে পারেন। নির্বাচন কর্মকর্তারা অনিয়মে জড়ালে আইনে তাদের সাসপেন্ড করার বিধান আছে। কিন্তু ওই আইনের প্রয়োগ দেখছি না। তিনি বলেন, দিনের ভোট, রাতের ভোট নিয়ে সমালোচনা আছে। সামনের নির্বাচনে এসব নিয়ে আর সমালোচনা যেন না আসে, সেদিকে নজর দিতে হবে।
এটিএন বাংলার প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জ ই মামুন বলেন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি না এলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। আপনারা চান একটি ভালো নির্বাচন হোক। আপনারা চেষ্টা করবেন বিএনপি যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। সেরকম একটি আস্থার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তিনি বলেন, অনেকেই বলেছেন রাতে নির্বাচন হয় না। আসলে রাতে নির্বাচন হয় না। রাতে ব্যালট পেপার দিয়ে ব্যালট বাক্স ভরে রাখা হয়। ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে পরের দিন। এগুলোই ঘটেছে বাংলাদেশে। আমরা এই কথাগুলো জেনেশুনেও বলি না, কারণ আমরা বলতে ভয় পাই, লিখতে ভয় পাই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা কতখানি, তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এখন আমার স্বাধীনতা আর নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা যদি এক রকম হয়, তাহলে আমাদেরকে এখানে (সংলাপে) ডাকার কোনো মানে হয় না। আমি মনে করি, নির্বাচন কমিশন আমার চাইতে স্বাধীন। নির্বাচন কমিশন যদি স্বাধীনভাবে কথা বলতে চায়, স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায়, তাহলে তাদের পক্ষে অনেক কিছু করা সম্ভব। নির্বাচন কমিশনের মেরুদণ্ড শক্ত থাকলে সরকারের খুব বেশি কিছু করার ক্ষমতা থাকে না। আপনারা চাইলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবেন। বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের গণমাধ্যম আপনাদেরকে সহায়তা করবে।
নিউজ ২৪-এর এক্সিকিউটিভ এডিটর রাহুল রাহা বলেন, নির্বাচনকালীন মিথ্যা প্রচার রোধে নজরদাবি করতে হবে। ভোট নিয়ে আস্থা ফেরাতে বড় দুই দলের মহাসচিব পর্যায়ে সংলাপের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
নাগরিক টিভির হেড অব নিউজ দীপ আজাদ বলেন, নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে, চাইলে সেই ক্ষমতা বলে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারে। তবে সেই ক্ষমতা তারা ব্যবহার করতে চায় কি না, এটা একটা বড় প্রশ্ন? ভোটকেন্দ্রের দায়িত্বে কে থাকবে-পুলিশ নাকি প্রিসাইডিং অফিসার, তা নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ মাসুদ কামাল বলেন, নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় সংকট হলো আস্থার সংকট। মানুষ নির্বাচন কমিশনের কথাবার্তায় বিশ্বাস করে না। গত দুটি নির্বাচনে এই বিশ্বাস শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। এক ব্যক্তির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, একজন নাগরিক বলেছেন ৩০ বছর বয়সে তিনি একবারও ভোট দিতে পারেননি। ইসির জন্য এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে। আপনারা কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন এই লোক আগামী দুই বছর পর ৩২ বছর বয়সে ভোট দিতে পারবেন? যদি প্রত্যেক নাগরিককে আপনি ভোট দেওয়া নিশ্চিত করতে পারেন, তাহলে বুঝব আপনি সফল।
মাছরাঙা টেলিভিশনের হেড অব নিউজ রেজোয়ানুল হক রাজা বলেন, আমাদের নির্বাচন কমিশন অনেক শক্তিশালী। দরকার এর আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ। ইসির যে ক্ষমতা আছে তা দৃশ্যমান হতে হবে। ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের চিফ নিউজ এডিটর আশিস সৈকত বলেন, ইভিএম জাল ভোট কমিয়েছে, এটা নিঃসন্দেহে সত্য। তবে ইভিএম নিয়ে যেসব বিতর্ক রয়েছে তা নিরসন করতে হবে। প্রার্থী ও তাদের প্রতিনিধিদের সামনে ইভিএম কাস্টমাইজ করতে হবে।
আরও বক্তব্য দেন-ডিবিসি নিউজের সিইও মঞ্জুরুল ইসলাম, দেশ টিভির চিফ নিউজ এডিটর মো. বোরহানুল হক সম্রাট, এনটিভির বার্তাপ্রধান জহিরুল আলম, চ্যানেল আইয়ের প্রধান বার্তা সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান, আরটিভির সিইও সৈয়দ আশিক রহমান, একুশে টিভির হেড অব নিউজ রাশেদ চৌধুরী, বাংলাভিশনের হেড অব নিউজ আব্দুল হাই সিদ্দিক, মাইটিভির হেড অব নিউজ শেখ নাজমুল হক সৈকত, সময় টিভির হেড অব নিউজ মুজতবা দানিশ, চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ ও স্পাইস টিভির এডিটোরিয়াল হেড তুষার আব্দুল্লাহ।