জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিক দিনে ভোটগ্রহণ নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সংলাপে আসা সুপারিশ অবাস্তব ও অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা। আওয়ামী লীগ ও সমমনা কয়েকটি দলের নেতারা বলেছেন, দেশের পারিপার্শ্বিক ও ভোটারদের মানসিক অবস্থা বিবেচনায় একদিনেই ভোটগ্রহণে অভ্যস্ততা গড়ে ওঠেছে। একাধিক দিনে ভোটগ্রহণের সংস্কৃতি চালু করতে গেলে নির্বাচন নিয়ে নতুন করে নানা ধরনের সন্দেহের সৃষ্টি হবে। অপরদিকে একদিনে ভোটগ্রহণ করার পরও কারচুপি হচ্ছে বলে অভিযোগ বিএনপি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের। ভোটে এসব অনিয়ম বন্ধের দাবি তাদের। ছয়টি রাজনৈতিক দলের সাতজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা উঠে আসে।
নির্বাচন কমিশনের সাম্প্রতিক সংলাপগুলোতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একাধিক দিনে ভোটগ্রহণের বিষয়ে আলোচনা সামনে আসে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন কমিশনের উদ্যোগে সংলাপে কয়েকজন বক্তা এ ধরনের সুপারিশ করেন। এর আগে সাবেক সিইসি কেএম নূরুল হুদা কমিশনের সময়ে সংলাপেও এ বিষয়টি উঠে এসেছিল। যদিও ওই কমিশন একাধিক দিনে ভোটগ্রহণের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বর্তমান কমিশনও এখনও কোনো পদক্ষেপ না নিলেও সুপারিশগুলো পর্যালোচনার জন্য রেখেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২-এর ১১ ধারায় একাধিক দিনে ভোটগ্রহণের দিন নির্ধারণের সুযোগ ইসিকে দেওয়া আছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার ভাষ্য, একদিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের সংস্কৃতি রয়েছে। এ সংস্কৃতির বাইরে গিয়ে একাধিক দিনে ভোটগ্রহণের সুপারিশ আসায় তারা কিছুটা বিস্মিত। একাধিক দিনে ভোটগ্রহণের সুপারিশের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক যুগান্তরকে বলেন, ‘আমাদের ভৌগোলিক সীমানার কথা চিন্তা করলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের বিদ্যমান ব্যবস্থাই সঠিক। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং নির্বাচনি কাজে যুক্ত জনবলের যথেষ্ট সক্ষমতা আছে একদিনে নির্বাচন করার। এ ব্যবস্থার যৌক্তিকতা অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে। তাই হঠাৎ করে একাধিক দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের প্রস্তাব কেন করা হলো তা বোধগম্য নয়। তবে প্রস্তাবটি যেহেতু নির্বাচন কমিশনের কাছে করা হয়েছে, তারা নিশ্চয় এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করে তাদের মতামত জানাবে।’
তবে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে ভোটগ্রহণ একদিনে হোক বা একাধিক দিনে হোক-তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না বলে মনে করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘এই সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ক্ষমতাসীন দল যেভাবেই হোক কারচুপি করবে। তাই সংলাপে যত রকমের সুপারিশ আসুক, তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা ও যৌক্তিকতা থাকবে না। এ কারণে নতুন নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে আমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করছে নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর। এই সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সব নির্বাচন প্রমাণ করেছে তারা শুধু একপেশে নির্বাচন করবে। অতএব এ সরকার ক্ষমতায় থাকলে কোনো পদ্ধতির নির্বাচনই গ্রহণযোগ্য হবে না। এইজন্যই আমরা বলে আসছি, এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাব না। নির্বাচন পদ্ধতি কী হবে তা পরে দেখা যাবে।’
চলমান ইসির সংলাপে বিভাগ ভিত্তিক বা একাধিক দিনে ভোটগ্রহণের সুপারিশ করেন বেশ কয়েকজন বক্তা। এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে তারা বলেন, একাধিক দিনে ভোটগ্রহণ করা হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ভাগ করে মোতায়েন করা যাবে। এতে নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশি সংখ্যক সদস্য নিয়োগ দেওয়া যাবে। এ বিষয়ে প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, এখন কেন্দ্রীয়ভাবে ভোট চুরি হয়।
ফলাফল বদলে দেওয়া হয়। ভাগ ভাগ করে ভোট হলে চুরির বিকেন্দ্রীকরণ হবে। তাই এসব আজগুবি প্রস্তাব না দিয়ে বাস্তবতসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, জাতীয় সংসদে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণে কালো টাকা ও পেশি শক্তির প্রভাবমুক্ত অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। প্রায় একই মন্তব্য করেছেন সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এমপি বলেন, ৩০০ আসনে একসঙ্গে নির্বাচনের যে প্রচলিত আইন রয়েছে সেটাই শ্রেয় আইন। এর ব্যত্যয় ঠিক হবে না। তিনি বলেন, প্রচলিত ব্যবস্থায় অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
একাধিক দিনে ভোটগ্রহণ হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক আরও বাড়বে বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, একাধিক দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের পরিবেশ বা মানসিকতা এখনো আমাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরস্পরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস বহাল রয়েছে। প্রত্যেকটি নির্বাচনে পরাজিত রাজনৈতিক দল নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হওয়ার বিষয় নিয়ে অভিযোগ করেছে। তাই একাধিক দিনে নির্বাচন হলে বিতর্ক আরও বাড়বে।
একই দিনে নির্বাচন না করে ভাগ ভাগ করে নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তাব পুরোপুরি অবাস্তব বলে দাবি করেন সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি। যুগান্তরকে তিনি বলেন, এটি করতে হলে পুরোপুরি আইন বদলাতে হবে। আমাদের আইনে আছে, ভোটগ্রহণ শেষে পোলিং এজেন্টদের উপস্থিতিতে ভোটগণনা শেষ করে প্রিজাইডিং অফিসার ফলাফল ঘোষণা করবেন। রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, ভারতের প্রেক্ষাপট আর আমাদের প্রেক্ষাপট এক নয়। আমরা ছোট দেশ। এখানে একসঙ্গে ৩০০ আসনে ভোট না হলে সমস্যা আরও বাড়বে। নতুন সংকট তৈরি হবে।
সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, একাধিক দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হলে সংকট আরও বাড়বে। কারণ সংকট তৈরি করতে পারে যারা তারা এক জায়গায় ফ্রি হয়ে গেলে অন্য জায়গায় চলে যাবে। কাজেই এ ধরনের সুপারিশ বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে যৌক্তিক বলা যায় না।