কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়া নিয়ে চা শ্রমিকদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। রোববার রাতে শ্রমিক নেতারা কাজে যোগ দেয়ার ঘোষণা দিলেও অনেক বাগানের শ্রমিকরা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা গতকাল কাজে যোগ না দিয়ে বিক্ষোভ ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছেন। কিছু বাগানের পরিস্থিতি ছিল শান্ত। শ্রমিকরা কাজে যোগ দিয়েছেন।
এম ইদ্রিস আলী, শ্রীমঙ্গল থেকে জানান, চা-শ্রমিকদের আন্দোলন নতুন মোড় নিয়েছে। আন্দোলনের গতি আরও একধাপ বেড়ে প্রতিটি বাগানে বাগানে আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। বাগান কিংবা আঞ্চলিক মহাসড়কে সমানতালে বিক্ষোভ মিছিল, সড়ক অবেরোধের মতো কর্মসূচিতে ছাত্র, যুবক, নারী- পুরুষদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাজার হাজার শ্রমিকের ঢল নেমেছে।
গত রোববার রাতে মৌলভীবাজারে প্রশাসনের সঙ্গে চা-শ্রমিক ইউনিয়নের বৈঠকে কাজে যোগ দেয়ার যে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, তা প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ শ্রমিকরা আন্দোলন তীব্র থেকে আরও তীব্রতর করছে। তারা ‘রাতের অন্ধকারের সিদ্ধান্ত’ মানেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে আন্দোলনে অনঢ় রয়েছেন শ্রমিকরা।
জেলা প্রশাসন ও চা-শ্রমিক ইউনিয়নের রোববার রাতের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে আবার ধর্মঘটে অংশ নিয়েছেন মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার সাধারণ চা-শ্রমিকেরা।
গতকাল সকাল থেকে শ্রমিক নেতাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজে ফিরেছিলেন উপজেলার ভাড়াউড়া, ভুরভুরিয়াসহ কয়েকটি চা বাগানের শ্রমিকেরা। কিন্তু অন্যান্য বাগানের শ্রমিকেরা কাজে যোগ না দেয়ায় তারাও কাজ বন্ধ করে ধর্মঘটে অংশ নেন। কাজে ফেরার সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ধর্মঘটে অংশ নেন উপজেলার কালিঘাট ও ফুলছড়া চা বাগানের শত শত শ্রমিক।
এদিকে বেলা ১১টায় বিক্ষুব্ধ চা-শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলতে শ্রীমঙ্গলের কালীঘাট চা বাগানে যান বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি পংকজ কন্দ। শ্রমিকদের গত রোববার রাতের সভার কথা বোঝাতে ও ধর্মঘট প্রত্যাহার করার কথা বলতে গিয়ে সাধারণ শ্রমিকদের হাতে লাঞ্ছিত হন তিনি। দুপুর ১২টার দিকে কালীঘাট চা-বাগান থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি ফুলছড়া চা-বাগান হয়ে ভাড়াউড়া চা-বাগানে এসে শ্রমিকের ঢল নামে।
এর আগে রোববার রাত ৯টা থেকে ৩টা পর্যন্ত একটানা মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চা-শ্রমিক নেতাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আস্থা রেখে আগের ১২০ টাকা মজুরিতে কাজে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। দুই পক্ষ যৌথ বিবৃতিতে এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়।
স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট থেকে জানান, এখনো কাজে ফিরেনি চা শ্রমিকদের একাংশের কর্মীরা। তারা এখন ক্ষুব্ধ চা শ্রমিক নেতাদের উপর। গতকাল সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের ক্ষুব্ধ চা শ্রমিকদের অংশের হাতে প্ল্যাকার্ডে লিখা ছিল; ‘আটা রুটির সংগ্রাম, চলছেই চলবে’। এ সময় তারা দাবি করেন. ‘নেতারা পকেটে ঢুকে গেছে আমরা ঢুকবো না। আমরা ১২০ টাকা মজুরি মানি না। আমাদের মাঠে নামিয়ে তারা উধাও। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই। আমরা ডাল-ভাত খেয়ে ভালো করে বাঁচতে চাই।’ এর আগে ভোররাতের দিকে শ্রীমঙ্গলে চা শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সভা শেষ হয়। রাতভর অনুষ্ঠিত এ সভা শেষে শ্রমিকরা যৌথভাবে আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। এ সময় তারা জানান, ‘১৪৫ মজুরি তারা নেবে না। ১২০ টাকায়ই তারা কাজে ফিরছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভার্চ্যুয়াল সভার পর তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।’ এই ঘোষণার পর সকাল থেকে সিলেট অঞ্চলের বেশির ভাগ বাগানের শ্রমিকরা কাজে ফেরে। সকাল থেকে তারা দল বেঁধে গিয়ে চাপাতা সংগ্রহ শুরু করে। তবে- সিলেটের মালনিছড়াসহ কয়েকটি বাগানের শ্রমিকরা তাদের সিদ্ধান্তে অনঢ় থাকেন। যে আন্দোলনে রয়েছে সেই আন্দোলন চলমান থাকবে বলে ঘোষণা দিয়ে তারা সিলেটে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছেন। এ সময় চা শ্রমিক ফেডারেশনের সংগঠক অজিত রায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘১৩ দিন ধরে শ্রমিকরা খেয়ে না খেয়ে আন্দোলন করছে, অথচ রাতের অন্ধকারে ১২০ টাকায় কাজে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো! এটা তো হঠকারী সিদ্ধান্ত। আমাদের দাবি, ৩০০ টাকা মজুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি আমাদের সঙ্গে সরাসরি ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন, তবেই আমরা কাজে ফিরে যাবো।’
কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি জানান, আগের ১২০ টাকা মজুরিতেই চা-বাগানে কাজে ফেরার সিদ্ধান্তে কমলগঞ্জের পদ্মছড়া চা বাগানে শ্রমিকরা সেকশনে কাজ করতে গেলে তাদেরকে মাধবপুর চা বাগানের কিছু শ্রমিক মারধর করেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে হামলার এ ঘটনা ঘটে। এ সময় বাগান পঞ্চায়েত সভাপতি কৃষ্ণ লাল দেশওয়ালার দোকানে হামলা ও লুটপাট করা হয় এবং তার কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে মারধর করা হয়। চা শ্রমিক কমলা বাত্তি ও মনি সাঁওতাল বলেন, ডিসি অফিসের বৈঠকের সিদ্ধান্তে নেতারা কাজ করার কথা জানালে আমরা কাজে যাই। কিন্তু জাত ভাইরা আমাদের মারধর করলো। মির্তিঙ্গা চা বাগানে কিছু শ্রমিক কাজে ফিরলে তাদেরকেও বাধা দেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ক্ষুব্ধ চা শ্রমিকরা বেলা ১১টার দিকে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন এর মনু-দলই ভ্যালীর সাধারণ সম্পাদক নির্মল দাস পাইনকার বাড়ি ঘেরাও করেন। দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আলীনগর, ফুলবাড়ি চা বাগানের শ্রমিকরা উপজেলা পরিষদে অবস্থান নিয়ে নানা সেøাগান দেয়। তাদের সঙ্গে মাধবপুর, মদনমোহনপুরসহ আরও কয়েকটি চা-বাগানের শ্রমিকরা অংশ নেন। পরে দুপুর ২টার দিকে তারা কমলগঞ্জ উপজেলা চৌমুহনা চত্বরে অবস্থান নেন। এতে শমশেরনগর-শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ-মৌলভীবাজার সড়কে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় সড়কের উভয় পাশে ২শ’ যানবাহন আটকা পড়ে। চরম দুর্যোগে পড়েন যাত্রী সাধারণ। সড়কে অবস্থান নিয়ে চা শ্রমিকরা- রাতের আঁধারে চুক্তি চা শ্রমিক মানে না। ৩০০ টাকা মজুরি দে, নইলে বুকে গুলি দে/ শেখ হাসিনার সরকার ৩০০ টাকা দরকার/ মালিকের দালালরা হুঁশিয়ার সাবধানসহ নানা সেøাগান দিতে থাকেন। দুপুর আড়াইটার দিকে তাদের সঙ্গে কথা বলতে আসেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক রফিকুর রহমান, কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সিফাত উদ্দীন, কমলগঞ্জ থানার ওসি ইয়ারদৌস হাসান, ওসি তদন্ত আব্দুর রাজ্জাক। এ সময় বাগান পঞ্চায়েত নেতৃবৃন্দের একটি প্রতিনিধি দলকে সঙ্গে নিয়ে তারা পরিষদে ফেরেন। পরে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। পঞ্চায়েত নেতৃবৃন্দরা পরে ৩০০ টাকা মজুরি করার দাবিতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট প্রদান করার পর বিকাল ৫টায় চা শ্রমিকরা চৌমহনা চত্বর ত্যাগ করলে ৩ ঘণ্টা পর যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।
নূরুল ইসলাম মনি, বাহুবল (হবিগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, বাহুবলে আন্দোলনের মাঠ ছাড়তে অনড় চা শ্রমিকদের সাফ কথা, ‘প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাস ছাড়া অন্য কারও কথায় কাজে ফিরবো না।’ কর্মবিরতির ১৪তম দিনে গতকাল সকাল ১০টা থেকে রশিদপুর প্রাইমারি স্কুল মাঠে উপজেলার রশিদপুর, রামপুর, চিতলাছড়া, বালুছড়া চা বাগানের শ্রমিকরা মিলিত হয়ে বিক্ষোভ করে। সেটা দুপুর ২টা পর্যন্ত চলে। বিক্ষোভ চলাকালে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মহুয়া শারমিন ফাতেমা ও বাহুবল মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ রকিবুল ইসলাম খান সেখানে যান। পরে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকদের বুঝিয়ে কাজে যোগদানের অনুরোধ জানালেও শ্রমিকরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে অনড় থাকার কথা জানায়।