‘তুমি যেহেতু শ্বশুর বাড়ি যাবা, আমি নিজেই তোমাকে প্রাইভেটকারে দিয়ে আসি। বাবা চালকের আসনে, আমি তার বাম পাশে। বিমানবন্দর পার হতেই হঠাৎ প্রাইভেটভেটকারের ওপর আছড়ে পড়ে গার্ডার। লোকজন আমাকে ও স্ত্রী রিয়াকে উদ্ধার করেন। বাবাসহ অন্যরা হারিয়ে গেলেন চিরতরে’। গত সোমবার উত্তরায় প্রাইভেটকারে গার্ডার চাপায় নিহত আইয়ুব আলী রুবেলের (৫০) লাশ নিতে এসে তার ছেলে হৃদয় এভাবেই বাবার স্মৃতিচারন করেন।
রুবেলের অপর ছেলে শহিদুল ইসলাম রোমানও বাবাকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। বাবার মর্মান্তিক মৃত্যু প্রসঙ্গে রোমান বলেন, আমার বাবা আর দুনিয়াতে নেই। এখনো বিশ্বাস করতে পারছি। দুপুর ২ টা পর্যন্ত বাবা আমার সঙ্গেই ছিলেন, সেই যে বিদায় নিলো এটাই ছিল শেষবিদায়। বাবা নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করছিলেন। মৃত্যু যে কত নির্মম, দুনিয়াটা মুহূর্তেই চেঞ্জ হয়ে গেলো, আমার বাবার মৃত্যুর দায় কে নিবে? আল্লাহ তুমি এ শোক সইবার শক্তি দিও-আল্লাহ আমার বাবাকে জান্নাত নসিব করিও।
এদিকে কাঁদতেই যেন ভুলে গেছেন হাত থেকে মেহেদীর রং না ওঠা নববধূ রিয়া। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে যখন চলছিলো তার মা, শ্বশুর, খালাসহ ৫ জনের লাশের ময়না তদন্ত। তখন মর্গের বাইরে বাকরুদ্ধ রিয়া স্বামী হৃদয়ের হাতটি ধরে একদৃষ্টে তাকিয়েছিলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক পরে রিয়ার মুখে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। তিনি বলে উঠেন, ‘আমার মা মারা গেল। এই মা আমাকে কত কষ্ট করে বড় করল। বাবার মতো শ্বশুরও হারালাম। বেঁচে রইলোনা স্বজনও। দুইটা টাকা লাভের জন্য নিরাপত্তা ছাড়াই ব্যস্ত রাস্তায় গার্ডার ঝুলিয়ে রেখেছে তারা। আমার তো সব শেষ হয়ে গেল। তারা আমার এমন সর্বনাশ করল। ঝুলন্ত গার্ডার দেখেছি, ভাবতেও পারিনি এটা আমাদের ওপর পড়বে’। এ সময় নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে পুরো মর্গ এলাকা।
‘বুবু আমার হাঁসগুলি দেইখা রাইখো, আমার ফিরতে দেরি হবে। জামালপুর থেকে ঢাকায় বোনের মেয়ের বিয়েতে আসার আগে জা হাসনাকে এভাবেই বলে এসেছিলেন দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া ঝর্না বেগম। ঝর্নার পালিত হাঁসের জায়গায় হাঁস আছে, মুরগির জায়গায় মুরগিও আছে, নেই কেবল সে। এটা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না ঝর্ণার স্বামীও। স্ত্রী সন্তান হারিয়ে তিনিও পাগলপ্রায়।
গত সোমবার বিকেলে উত্তরায় নির্মাণাধীন বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে পড়ে নিহত হন প্রাইভেটকারের পাঁচ যাত্রী।
গতকাল মঙ্গলবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল মর্গে নিহতদের লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। বিকেল ৫টায় তিনটি ফ্রিজিং এ্যাম্বুলেন্সযোগে লাশগুলো দাফনের জন্য পরিবারের সদস্যদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক নাশেদ জাবিন। তিনি বলেন, ময়নাতদন্তে সুরতহালের চেয়ে আলাদা কিছু মেলেনি।
এদিকে মর্মন্তিক এ ঘটনায় সোমবার রাতেই উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলায় অবহেলাজনিতভাবে ক্রেন পরিচালনাকারী চালক, প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। পুলিশের পাশাপাশি র্যাব এ ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে। র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে পড়ে হতাহতের ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। মামলার পর থেকেই র্যাব জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু করেছে।
এ ঘটনায় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানসহ কয়েকটি কোম্পানিকে শর্তসাপেক্ষে কালো তালিকাভুক্ত (ব্ল্যাক লিস্ট) করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন।
এদিকে এ ঘটনায় বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন দুর্ঘটনায় মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটির প্রাথমিক তদন্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন, সড়ক সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। তিনি বলেন, সোমবারের ঘটনার মূল দায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। তারা কাউকে না জানিয়ে কাজ করছিল অথচ সেদিন কাজ বন্ধ থাকার কথা। তাদের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, এ ধরনের ব্যাপার ঘটলে তাদের যে দায়, সেই রকম ব্যবস্থাই তাদের বিরুদ্ধে নেওয়া হবে। এ নিয়ে বিশদভাবে বসবে মন্ত্রণালয় এবং আর কারও কোনো দায় আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, এ প্রকল্পের কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে শোকজ করা হচ্ছে।
সোমবার রাতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আখতারকে প্রধান করে ৫ সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি এক দিনের মধ্যে প্রাথমিক ও দুদিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়।
এদিকে বিআরটি পরিচালক ও সওজের প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম মনির হোসেন পাঠান বলেন, ক্রেন দিয়ে গার্ডার ওঠানোর সময় সবগুলো লেন বন্ধ করে একটি লেন গাড়ি চলাচলের জন্য রাখা হয়। কিন্তু সেখানে গাড়ির চাপ বেশি থাকার কারণে যে লেনে গাড়ি চলার কথা না সে লাইনেও গাড়ি চলে যায়।
তদন্ত কমিটির একাধিক সূত্র ও বিআরটি কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, কমিটি তাৎক্ষণিক যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে এ দুর্ঘটনার জন্য সরাসরি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসির চরম গাফিলতি ও অবহেলাকে দায়ী করেছে। এ ব্যাপারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।
বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কাল বৃহস্পতিবার নগরভবনে বৈঠক করবেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। এ পর্যন্ত তিনি প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন । বলেছেন, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর কাজ শুরু হবে।
গার্ডার চাপায় নিহত রুবেলের ৮ স্ত্রীর সন্ধান, মর্গে উপস্থিত ৫ জন
ক্রেন থেকে গার্ডার ছিটকে নিহত আইয়ুব আলী হোসেন রুবেলের (৫৫) আট স্ত্রীর সন্ধান মিলেছে। এর মধ্যে ৫ স্ত্রী ও আরেক স্ত্রীর এক সন্তান তার লাশ দেখতে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আসেন। মর্গের সামনে একে একে ৫ স্ত্রী এসে রুবেলকে স্বামী হিসেবে দাবি করেছেন। এরমধ্যে দুর্ঘটনার সময় বেঁচে যাওয়া সন্তান হৃদয় ও সন্তানের নববিবাহিতা স্ত্রী মনি থাকায় তাদের মা রেহানার বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে আলোচনায় রয়েছে। তবে আরেক স্ত্রী মানিকগঞ্জের সাহিদা নিজেকে স্ত্রী দাবি করে লাশ তার এলাকায় নিয়ে যেতে চান। তিনি নিজেকে রুবেলের স্ত্রী দাবি করে অনেক ছবি ও ডকুমেন্টস দেখান। তার কাছ থেকে রুবেল বিভিন্ন সময় বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়েছেন বলেও দাবি করেন। তবে ছেলে হৃদয়ের কাছেই লাশ হস্তান্তর করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।