ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছরই নিচে নামছে। আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২০০ থেকে ২৫০ ফুট গভীরেই পানির স্তর মিলত। এখন অনেক স্থানে ৭০০ ফুট গভীরে নেমেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। উত্তরাঞ্চলের অনেক নলকূপে পানি ওঠে না। ঢাকা ওয়াসারও অনেক নলকূপে পানি উঠছে না। ফলে ভূগর্ভে তৈরি হচ্ছে বিশাল শূন্যতা। এতে প্রাকৃতিক পরিবেশে বা ইকোসিস্টেমে ভারসাম্য ক্ষুণ্ন হয়ে নানা রকম ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ভয়াবহ ভূমিকম্প, ভূমিধস এবং লবণাক্ততা বৃদ্ধি।
এরমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি শুরু হয়ে গেছে। এ ছাড়া গত বছর মে জুনে দেশে অন্তত ১০ দফা ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। রিখটার স্কেলে খুব কম মাত্রার এসব ভূকম্পনে বড় ক্ষয়ক্ষতি না হলেও বিশেষজ্ঞরা একে বড় ধরনের ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন। ভূ-তত্ত্ববিদদের মতে, সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে। সর্বশেষ ১৮২২ ও ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসেবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের মুখে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। আর এর মধ্যে রাজধানী ঢাকা রয়েছে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ওয়াটার রিসোর্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তফা আলী ইনকিলাবকে বলেন, সারাদেশে সেচ কাজের জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া ফারাক্কা বাঁধসহ অভিন্ন অন্যান্য নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এদেশের নদ-নদীতেও এখন পানি নেই। অনেক নদীর বুকে এখন ধু ধু বালু চর। এ অবস্থায় গ্রাম অঞ্চলে সেচ কাজে এবং শহর অঞ্চলে খাবার এবং গৃহস্থালি কাজে ব্যাবহারের জন্য গভীর নলকূপের মাধ্যমে দেদারসে ভূগর্ভের পানি তোলা হচ্ছে। ফলে ভূগর্ভের পানির স্তর প্রতিনিয়ত নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে ভূগর্ভে শূন্যস্থান তৈরি হয়। আর তাতে ভয়াবহ ভূমিকম্প ও ভূমিধসের ঝুঁকি তৈরি হয়। এ বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে।
ষাটের দশকে অধিক উৎপাদনের সেøাগান নিয়ে আসে সবুজ বিপ্লব। আসে ইরি ৮, ইরি ৫, ইরি ২০ প্রভৃতি রবি মৌসুমের উফশী ধান। এর পুরো ফলন নির্ভরশীল সেচ, রাসায়নিক সার, বালাইনাশক ও যত্নের ওপর। এখন দেশের ৬০ শতাংশ চালের জোগান আসে উফশী ও হাইব্রিড বোরো থেকে। বর্ষার অতিবৃষ্টি, বন্যা বা খরায় আউশ ও আমন ফসল প্রায়ই মার খায়। সে তুলনায় রবি মৌসুমে প্রাকৃতিক বিপর্যয় কম থাকায় সেচনির্ভর বোরো ধান, গম প্রভৃতি ফসল নির্বিঘ্নে ঘরে তোলা যায়। বিশেষজ্ঞদের এসব চমকপ্রদ কথায় ও পরামর্শে আর বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় দেশে তখন শুরু হয় অনেক মেগা সেচ প্রকল্প।
গঙ্গা, কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্প (জিকে প্রজেক্ট), ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ- ডেমরা (ডিএনডি) প্রকল্প, উপকূলীয় বেড়িবাঁধ প্রকল্প, ব্রহ্মপুত্র ডান তীরবর্তী বেড়িবাঁধ প্রকল্প, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প, মেঘনা-ধনাগোদা প্রকল্প, গোমতী নদীতীর বাঁধ প্রকল্প, মুহুরি সেচ প্রকল্প, তিস্তা বাঁধ প্রকল্প, বরিশাল সেচ প্রকল্প প্রভৃতি নদীভিত্তিক সেচ প্রকল্প। এ ছাড়া চালু হয় উত্তরাঞ্চলে গভীর নলকূপের বিশেষ প্রকল্পগুলো। দেশব্যাপী গভীর নলকূপ ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ সেচ ব্যবস্থা বাড়তে থাকে। পরে স্থানীয় সরকারের বাঁধ, সøুইস গেট প্রভৃতি অবকাঠামো স্থাপনা বাস্তবায়ন হয়। এগুলোর বেশির ভাগই পরিবেশের জন্য প্রতিকূল হয়ে উঠে।
সাধারণত প্রতি কেজি আধুনিক ও উচ্চফলনশীল ধান উৎপাদনে গড়ে ৩ হাজার ৫০০ লিটার পানির প্রয়োজন। বরেন্দ্র অঞ্চলে তার চেয়েও বেশি পানির প্রয়োজন হয়। তবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এর সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা বিভাগের সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ১৫০০-২০০০ লিটার পানির প্রয়োজন। দেশে মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫ লাখ ৮৫ হাজার ২০৭ দশমিক ৪ হেক্টর। মোট সেচকৃত জমির পরিমাণ ৭৬ লাখ ১৪ হাজার ৫৭২ হেক্টর। এর মধ্যে আমন মৌসুমে ২০ লাখ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন পর্যায়ে সেচের প্রয়োজন হয়। দেশে আউশ, আমন ও বোরো তিন মৌসুমেই কমবেশি সেচের প্রয়োজন হয়।
দেশে বর্তমানে ৩৮ হাজার গভীর নলকূপ এবং ১৭ লাখ অগভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে সেচসহ অন্যান্য কাজে ব্যাবহার করা হচ্ছে। বর্তমানে কৃষিকাজে চাহিদার মাত্র ২৫ শতাংশ পানি ভূপৃষ্ঠ ও বাকি ৭৫ শতাংশ ভূগর্ভ থেকে উত্তোলিত হয়। কিন্তু অর্ধশতাব্দী আগেও চাষাবাদের জন্য ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮০ শতাংশ এবং ভূগর্ভ থেকে মাত্র ২০ শতাংশ পানি ব্যবহার করা হতো।
একইভাবে ওয়াসাও রাজধানীতে একের পর এক গভীর নলকূপ বসিয়ে বাড়িয়েছে ভূগর্ভস্থ থেকে পানির উৎপাদন। ফলে রাজধানীর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতিবছর তিন মিটার করে নিচে নামছে। এতে ভূগর্ভে তৈরি হচ্ছে বিশাল শূন্যতা। এ কারণে আকস্মিক দেবে যেতে পারে ঢাকা নগরী। এ ছাড়া ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতো আছেই।
ঢাকা ওয়াসার ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার উৎপাদিত পানির ৭১ শতাংশ আসছে গভীর নলকূপ থেকে। বাকি ২৯ শতাংশ আসছে ভূ-উপরিস্থ থেকে। প্রতিবছরই রাজধানীতে গভীর নলকূপের সংখ্যা বাড়ছে। ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার গভীর নলকূপ ছিল ৫১৯টি। ২০২১ সালের জুনে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩৪টিতে। এ ছাড়া ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন বাসা ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হয়েছে আরো দুই শতাধিক গভীর নলকূপ।
বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা শহরে গভীর নলকূপ স্থাপনের শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল ঢাকার আশপাশে অনেক নদী আছে। গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি তুললেও শীতলক্ষ্যা-বুড়িগঙ্গার পানি তলদেশ দিয়ে রাজধানীর ভূগর্ভের পানির শূন্যতা পূরণ করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। রাজধানী ঢাকার পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার পাশাপাশি বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা সংলগ্ন নারায়ণগঞ্জেও পানির স্তর নেমে গেছে। এর মানে রাজধানীর ভূগর্ভের পানির শূন্যতা পূরণ হচ্ছে না। এটা খুবই উদ্বেগের। এর ফলে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে ধসে যাওয়ার ঝুঁকিও। একসঙ্গে পুরো ঢাকা দেবে না গেলেও কিছু পকেট এলাকা দেবে যেতে পারে। এ রকম নজির বিশ্বের অনেক দেশেই আছে। পাশাপাশি ভূগর্ভে পানির শূন্যতা তৈরি হওয়ায় লবণাক্ততা ভর করবে, যেটা উপকূলীয় এলাকায় শুরু হয়েছে। আসলে ‘ভূ-উপরিস্থ পানির ওপর নির্ভরতা বাড়ানোর যে লক্ষ্য ঢাকা ওয়াসা ঠিক করেছিল, তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এটা ওয়াসার বড় ব্যর্থতা। ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেও ওয়াসা ভালো ফলাফল দিতে পারেনি। ফলে ঢাকা নগরের ইকো সিস্টেম কলাপস করে গেছে। এজন্য ঢাকা নগরী বড় ধরনের বিপদের ঝুঁকিতে রয়েছে। এব্যাপরে এখনই সরকারের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন।
ঢাকা ওয়াসা প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার পানি রাজধানীতে সরবরাহ করার লক্ষ্য নিয়ে পদ্মা-জশলদিয়া প্রকল্প নিয়েছিল। তিন হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর সেখান থেকে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ১৫ কোটি লিটার। এ ছাড়া আট হাজার ১৪৭ কোটি টাকা খরচায় বর্তমানে চলছে মেঘনা থেকে পানি আনার আরেকটি প্রকল্প। এ প্রকল্পের সুফল পাওয়া নিয়েও বিশেষজ্ঞরা শঙ্কা প্রকাশ করছেন।
জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৫০ কোটি লিটার পানি রাজধানীতে সরবরাহ করছে ঢাকা ওয়াসা। এর মধ্যে ১৮০ কোটি লিটার পানিই পাওয়া যাচ্ছে গভীর নলকূপ থেকে। বাকি ৭০ কোটি লিটার পানি আসছে পদ্মা-জশলদিয়া, সায়েদাবাদ ফেস-১ ও ২, চাঁদনীঘাটসহ মোট চারটি পানি শোধনাগার থেকে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক বলেন, ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাবহার কমাতে সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলে নিরাপদ পানি সরবরাহের কাভারেজ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ‘উপকূলীয় জেলাসমূহে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে পানি সরবরাহ’ শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় অধীনস্থ স্থানীয় সরকার বিভাগের আওতাধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর (ডিপিএইচই) দেশের উপকূলীয় ১০টি জেলার ৪৪টি উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। ৯৬১ কোটি ৭৫ লাখ ৫২ হাজার টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০২৪ সালের ৩১ অক্টোবরের মধ্যে এটি সম্পূর্ণ বাস্তায়নের কথা রয়েছে।