মধ্য আকাশে গনগনে সূর্য। গ্রীষ্মের খরতাপে ফেটে চৌচির বরেন্দ্র অঞ্চল। পানিস্তর নেমে যাওয়ায় গ্রামের কোনো টিউবওয়েলে ওঠে না একবিন্দু পানি। পিপাসায় অনেক সময় পুকুরের পানিই পান করেন বাসিন্দারা। শুধু পানির অভাবে গ্রাম ছেড়েছে প্রায় অর্ধেক বাসিন্দা। তানোরের বাধাইড় ইউনিয়নের ঝিনাখৈড় গ্রামের চিত্র এটা। গ্রামের বাসিন্দা অগাস্টিন গোমেজ (৫৮) বলেন, ‘খাওয়ার পানি কয়েক মাইল দূরের কৃষিজমির গভীর নলকূপ থেকে আনতে হয়। সবসময় তো আর সম্ভব হয় না। জীবন বাঁচাতে পুকুরের পানি পান করে মানুষ। শুধু পানির জন্য উজাড় হয়ে যাচ্ছে গ্রাম। আমন ধান ছাড়া আর কোনো ফসল হয় না। এখন মাত্র আর ২২ ঘর মানুষ আছে এ গ্রামে।’
বিশুদ্ধ পানির সংকট শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলে নয় উপকূল, পাহাড় ছাপিয়ে সে আঁচ লেগেছে রাজধানীতেও। দূষিত পানি পান করে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। রাজধানীর হাসপাতালে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগীর ভিড়। নামছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রতি বছর ১০ ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে। শিল্প কারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। বেড়েই চলছে নদীদূষণের মাত্রা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ত পানি উজানে প্রবাহিত হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্র স্তরের উচ্চতা বৃদ্ধির বিরূপ প্রভাব
বাংলাদেশে ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছে। সবকিছু মিলিয়ে বিশুদ্ধ পানি প্রাপ্তিই চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।
রাজধানীতে প্রতিদিন পানির চাহিদা থাকে ২৪৫-২৫০ কোটি লিটার। ঢাকা ওয়াসার পানি সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে ২৭৫ কোটি লিটার। পাঁচটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টে পানি পরিশোধন এবং গভীর নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে রাজধানীবাসীর পানির চাহিদা পূরণ করে ওয়াসা। এ পানির ৬৬ শতাংশই ভূগর্ভস্থ পানি এবং ৩৪ শতাংশ নদীর পানি পরিশোধন করে ব্যবহার উপযোগী করা হয়। শুষ্ক মৌসুম আসতেই রাজধানীর কিছু জায়গায় পানির সংকট শুরু হয়েছে। ওয়াসার পাম্প নষ্ট হলে সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। ওয়াসার গাড়িতে পানি সরবরাহ করা হলেও তা অপ্রতুল। ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি সুপেয় না হওয়ায় তা সংগ্রহ করে ফুটিয়ে পান করে নগরবাসী।
ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজধানীর দুই কোটির বেশি মানুষের পানির চাহিদা প্রতিদিন আমাদের পূরণ করতে হয়। এর মধ্যে অনেক মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে ঢাকায় আসেন, আবার চলে যান। এ জনবহুল শহরে পরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা দুরূহ কাজ। শুষ্ক মৌসুম এলে পানির স্তর নেমে যায়। এ সময় পানি সরবরাহ ঠিক রাখতে হিমশিম খেতে হয়। এ জনবহুল শহরে প্রতিনিয়ত বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং। গ্রীষ্ম মৌসুমে শীতলক্ষ্যার তিনটি পয়েন্টে পানির দূষণ বেড়ে যায়। এ পানি নদী থেকে সংগ্রহ করে প্রি-ট্রিটমেন্ট করার পর পরিশোধন করতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কিছু ‘পকেট’ সমস্যা ছাড়া স্থায়ী পানির সমস্যা রাজধানীতে নেই। হঠাৎ করে পাম্প নষ্ট হয়ে গেলে মেরামত কিংবা পরিবর্তন করা পর্যন্ত ওই এলাকায় পানির সমস্যা তৈরি হয়। এ জন্য পানি সরবরাহে পর্যাপ্ত গাড়ি প্রস্তুত রাখা হয়েছে। রাজধানীর ১০টি জোনের মধ্যে দুটি জোন যাত্রবাড়ী এবং মিরপুরের কিছু জায়গায় মাঝেমধ্যে পানির সমস্যা দেখা দেয়।’ দূষিত পানি পানে গত মাসের মাঝামাঝি থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী বেড়েছে। রাজধানীর আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৬৬৪ জন। গত শনিবার এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন এক হাজার ২৭৪ জন।
দেশে ভূগর্ভস্থ পানি খরচের আরেকটি জায়গা কৃষিজমির সেচ। মোট চাষকৃত জমির প্রায় ৭৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ ভূগর্ভস্থ পানি এবং বাকি ২৬ দশমিক ৫৬ শতাংশ ভূউপরিস্থ পানির দ্বারা সেচ করা হয়। অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে, নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, বাড়ছে ঝুঁঁকি।
বাংলাদেশ নিরাপদ পানি আন্দোলন (বানিপা) সভাপতি প্রকৌশলী মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘রাজধানীর পানির স্তর প্রতি বছর ১০ ফুট করে নামছে। এত উন্নয়নের ভিড়ে বৃষ্টির পানি মাটির স্তর ভেদ করে ভূগর্ভে পৌঁছাতে পারছে না। উপকূল অঞ্চলের ভূগর্ভে এক হাজার ৫০০ ফুটর নিচে গেলেও পানি মিলছে না। পানি রিচার্জের কোনো ব্যবস্থা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), ওয়াসা, সিটি করপোরেশনের ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণ বাড়াতে কোনো উদ্যোগ নেই। রাজধানীর বাসাবাড়ির সুয়্যারেজের সংযোগ ড্রেনে দেওয়া। পয়ঃবর্জ্য গিয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যায়। দূষিত হচ্ছে খাল-বিল, নদীর পানি। দিনে দিনে বিশুদ্ধ পানির প্রাপ্যতা কঠিন হয়ে পড়ছে।’ সার্বিক বিষয়ে পানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাজধানীর পানি ব্যবস্থাপনা ঘিরে কোনো পরিকল্পনা নেই। ২০ বছর আগেও দেখেছি ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে পানি সরবরাহ চলছে, এখনো অবস্থা তা-ই আছে। পানি উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে কিন্তু গুণগত মান বাড়েনি। অনেক জায়গায় পানির গতি থাকে না, সংযোগ লাইনে ছিদ্র থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সুয়্যারেজের সংযোগ ড্রেনে দিয়ে বর্জ্য ফেলা হচ্ছে চারপাশের জলাধারে। নিজের চারপাশের ভালো পানিকে পয়ঃবর্জ্য ফেলে দূষিত করে পদ্মা-মেঘনা থেকে পানি আনা হচ্ছে। এতে বাড়ছে পানি উৎপাদন খরচ। এ বাড়তি খরচ চাপানো হচ্ছে ভোক্তার কাঁধে পানির দাম বাড়িয়ে। অথচ ঢাকার পাশের শীতলক্ষ্যার পানি ছিল বিশ্বের অন্যতম বিশুদ্ধ পানির আধার। শীতলক্ষ্যাকে দূষিত করে ফেলা হয়েছে বর্জ্য ফেলে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে পানি নিয়ে কঠিন সংকটে পড়তে হবে।’