দেশে ৬৫ দিন সাগরে সব ধরণের মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার গত ২০ মে থেকে। নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে আগামী ২৩ জুলাই পর্যন্ত। মাছ ধরতে না পারায় উপকূলের মৎস্যজীবিরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে খুবই দূরবস্থার মাঝে দিন কাটাচ্ছেন। চরম অভাব অনটনের মাঝ দিয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন, কবে নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হবে। দেশের মৎস্যজীবিদের যখন এমনই করুণ অবস্থা, ঠিক সেই একই সময় ভারতীয় মৎস্য লুটেরারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ফাঁকি দিয়ে লুট করে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের মৎস্য সম্পদ। কোস্টগার্ডের অভিযানে ভারতীয় জেলেরা ধরা পড়ছে ঠিকই, কিন্তু থেমে থাকছে না তাদের আগ্রাসন।
জানা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশের পানিসীমায় প্রবেশ করে ভারতীয় জেলেরা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর চোখকে ফাঁকি দিয়ে মাছ ধরে নিয়ে যায়। আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে বছরের পর বছর তারা সাগরে এভাবেই আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায়ই কোস্টগার্ডের অভিযানে ভারতীয় ট্রলারসহ জেলেরা আটক হয়, কিন্তু তারপরও তারা দ্রুতগামী ট্রলার ও মাছ ধরার অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি-সরঞ্জাম নিয়ে বাংলাদেশের পানিসীমায় প্রবেশ করে। আতঙ্কের আরেকটি কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশে যখন মাছ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, ভারতে সে সময় নিষেধাজ্ঞা থাকে না। এ সময়টিতে ওই দেশের জেলেরা বাংলাদেশের পানিসীমা অতিক্রম করে অসংখ্য ট্রলার নিয়ে মাছ ধরে। ফলে নিষেধাজ্ঞা অতিবাহিত হলে এ দেশের জেলেরা যখন জাল ফেলে, আশানুরূপ মাছ পায় না।
সার্বিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে খুলনা জেলা মৎসজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি মোল্লা সামছুর রহমান শাহিন জানান, ভারতের জেলেরা প্রতিনিয়ত আমাদের মাছ লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। প্রজনন মৌসুমে বাংলাদেশে যখন মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়, ভারতে তখন এ নিষেধাজ্ঞা থাকে না। ফলে সহজেই ওরা এসে মাছ ধরে নিয়ে যায়। এ সময় মাছ ধরতে না পেরে আমাদের জেলেরা অনাহারে অর্ধাহারে থাকে। একই সময়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে দু’দেশই লাভবান হত। তিনি আরো বলেন, গত বছর দুবলার চর এলাকায় ভরা মৌসুমে ইলিশ না পেয়ে হাজার হাজার জেলে খালি হাতে ফিরেছে। কারণ তার আগেই ভারতীয় জেলেরা ইলিশ ধরে নিয়ে যায়। এবারও এ আশঙ্কা রয়েছে।
খুলনার পাইকগাছা মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি বিকাশ চন্দ্র বিশ্বাস জানান, নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পর জেলেরা সাগরে গেলে মাছ পায় না। দু’মাস বন্ধ থাকার কারণে জাল ফেললেই ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ধরা পড়ার কথা। এর পেছনে একটাই কারণ ছিল। আমাদের মাছ চুরি করে নিয়ে যায় পার্শ্ববর্তী দেশের জেলেরা।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর সুন্দরবন সংলগ্ন সাগর পাড়ের দুবলা, মেহের আলীর চর, আলোরকোল, অফিস কিল্লা, মাঝের কিল্লা, শেলার চর, নারকেল বাড়িয়া, ছোট আম বাড়িয়া, বড় আম বাড়িয়া, মানিক খালী, কবর খালী, চাপড়া খালীর চর, কোকিলমনি ও হলদা খালীর চরে হাজার হাজার জেলে ও মৎস্যজীবি জড়ো হয়। এসব চরে অবস্থান নিয়ে জেলেরা সমুদ্র মোহনায় মৎস্য আহরণ করে। পাশাপাশি জেলেরা সেখানে নিজেদের থাকা ও শুঁটকি তৈরির জন্য অস্থায়ী ঘর তৈরি করে। জেলেরা সমুদ্র মোহনায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ শিকার করে শুঁটকি করার পর তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমনকি বিদেশেও বাজারজাত করা হয়। বর্তমানে স্থানীয় বনদস্যুদের উপদ্রব নেই বললেই চলে। আতঙ্ক শুধু ভারতীয় জেলেদের নিয়ে। প্রায়ই অভিযোগ পাওয়া যায়, তারা বড় বড় ট্রলার নিয়ে এসে বাংলাদেশের জেলেদের ছোট ছোট ট্রলারকে ধাক্কা দেয়। জেলেদের অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে। জেলেরা যেখানে জাল ফেলে, ইচ্ছাকৃতভাবে তারা তাদের ট্রলার সেখান দিয়ে চালায় যাতে জাল ছিড়ে যায়। তারা অত্যাধুনিক ট্রলার ব্যবহার করে। থাকে নানা ধরণের আধুনিক যোগাযোগ সরঞ্জাম। এক জায়গায় অভিযানের খবর পেলে তারা দ্রুত তা অন্যদের জানিয়ে দেয়।
কোস্টগার্ডের একটি সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলে গত এক বছরে ৭৪ ভারতীয় জেলেকে ৫টি ট্রলারসহ আটক করা হয়। আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর বাংলাদেশের পানিসীমা বৃদ্ধি পেয়েছে আরো ১৯ হাজার বর্গকিলোমিটার। পূর্ণ অধিকারে থাকা বিশাল বিস্তৃত এ পানিসীমা বাংলাদেশের জন্য অরক্ষিত না হলেও নানা সীমাবদ্ধতার কারণে এখনো পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
কোস্টগার্ড পশ্চিম জোনের (মোংলা সদর দফতর) অপারেশন কর্মকর্তা লে. কমান্ডার শেখ মেজবাহ উদ্দিন আহাম্মেদ জানান, সুন্দরবন এবং সাগর এলাকায় সবসময় দস্যু দমন বনজ সম্পদ ও বন্যপ্রানী সংরক্ষণে অভিযান অব্যাহত থাকে। মোংলা থেকে দুবলার চর পর্যন্ত কোস্টগার্ড নিয়মিত টহলে রয়েছে।
প্রসঙ্গত, গত সোমবার নৌ-বাহিনীর একটি টহল জাহাজ পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা সংলগ্ন রাবনাবাদ চ্যানেলের অদূরে পায়রা ফেয়ারওয়ে বয়া এলাকায় বিপুল সংখ্যক বিদেশি ফিশিং ট্রলারের অবস্থান শনাক্ত করে। পরে গভীর সমুদ্রে টহলরত নৌবাহিনীর জাহাজ বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক পানিসীমা থেকে ৩৬-৬০ নটিক্যাল মাইল অভ্যন্তরে ৮টি ভারতীয় ফিশিং ট্রলারকে অবৈধভাবে মৎস্য আহরণরত অবস্থায় ১৩৫ জন ভারতীয় ক্রুসহ আটক করে। ক্রুসহ ফিশিং ট্রলারগুলোকে বিধি মোতাবেক প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে বাগেরহাট জেলার মোংলা থানায় হস্তান্তরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।