* তিন বছরে ৪ হাজার ৬৪৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ৪ হাজার ৬২২ জন
উদ্বোধনের পর প্রথম দিনই বেপরোয়া গতিতে চালানোয় পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুই যুবক নিহত হয়েছেন। গত রোববার রাত সাড়ে ১০টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। পরে পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার। রাজধানীসহ সারাদেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বাড়ছে আশঙ্কাজনক ভাবে। গত তিন বছরে ৪ হাজার ৬৪৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬২২ জন। বিশেষ করে ঈদ যাত্রায় এই দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। মোটরসাইকেল নিহতের পাশাপাশি গুরুতর আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করছেন অনেকে। বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মোটরসাইকেলের কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত বা আহতের বেশিরভাগই কিশোর যাদের বয়স ২০ বছরের কম। গত ঈদযাত্রায় (ঈদুল ফিতর) দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। এসময় ১৬৪টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৪৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে অন্তত ১১০ জন। এই হিসাব মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৪৪.০৮ শতাংশ এবং দুর্ঘটনায় মোট নিহতের ৩৪.৮৫ শতাংশ ও আহতের প্রায় ১৩.০৩ শতাংশ।
কিশোর-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোর কারণে তারা নিজেরা দুর্ঘটনায় পতিত হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। মোটরসাইকেল উৎপাদন ও আমদানির ক্ষেত্রে সরকার নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, ফলে দেশে মোটরসাইকেলের ব্যবহার ব্যাপকহারে বাড়ছে। রাজধানীর বাইরে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে অধিকাংশ মোটরসাইকেল চালকের নিবন্ধন ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অনেকে রাজনৈতিক পরিচয়ে অথবা প্রভাবশালী পরিচয়ে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ান। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিরাপত্তা বিষয়ে অজ্ঞতা, অবহেলা ও ট্রাফিক আইনের প্রয়োগহীনতা বাইক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। এদিকে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ফি কমানোর সরকারি সিদ্ধান্ত এবং সিসিসীমা (অশ্বশক্তি) উন্মুক্ত করার সুপারিশ সড়কে বাইক দুর্ঘটনা বাড়াবে বলে আশঙ্কা করছেন অনেকে। গত কয়েক মাসে বাইকে নিহত পুলিশ সদস্যের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। বিষয়টি নাড়া দিয়েছে পুলিশ সদর দফতরকে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৩১ লাখের বেশি, যা মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। শুধু ঢাকাতেই নিবন্ধিত মোটরসাইকেল ৮ লাখের মতো। এর বাইরে একটি বড় অংশের মোটরসাইকেল অনিবন্ধিত। বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর হিসাবে, দেশে বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি হয়।
বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন জানায়, গত তিন বছরে ৪ হাজার ৬৪৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪ হাজার ৬২২ জন। এর মধ্যে বিদায়ী বছর ২০২১ সালে ২ হাজার ৭৮টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ২১৪ জন। আগের বছর ২০২০ সালে ১ হাজার ৩৮১টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪৬৩ জন। এছাড়া ২০১৯ সালে দেশে ১ হাজার ১৮৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিল ৯৪৫ জন। পরের বছর ২০২০ সালে এ মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৪৬৩ জনে; যেখানে দুর্ঘটনা ঘটে ১৩৮১টি। ২০২১ সালে ২০৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ২ হাজার ২১৪ জন। সব মিলিয়ে গত তিন বছরে ৪৬৪৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ৪৬২২ জনের। ২০১৯ সালের তুলনায় গত বছর এ মৃত্যুর হার ১৩৪ শতাংশ বেড়েছে।
সংগঠনটির তথ্য মতে, সদ্য বিদায়ী ২০২১ সালে দেশে পাঁচ হাজার ৩৭১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ছয় হাজার ২৮৪ জন মারা গেছেন, আহত ৭ হাজার ৪৬৮ জন। এর মধ্যে ২০৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ২ হাজার ২১৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। এসময় ১ হাজার ৫২৩ জন পথচারীসহ ৭৯৮ জন, নিহতদের মধ্যে নারী ৯২৭, শিশু ৭৩৪ এবং যানবাহন চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৬.১৪ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪.৮১ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ৫০.৪৭ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫১.৩৩ শতাংশ। এছাড়া সব শেষ বছর ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০৭৮টি, নিহত হয়েছে ২ হাজার ২১৪ জন, আহত ১ হাজার ৩০৯ জন। নিহতের মধ্যে ৭৪.৩৯ শতাংশ ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ২০১৪টি (৩৮.৪৯ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ১৬৭০ টি (৩১.০৯ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে ৯৫৪টি (১৭.৭৬ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে, ৬৬৫টি (১২.৩৮ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং অন্যান্য স্থানে ৬৮টি (১.২৬ শতাংশ) সংঘটিত হয়েছে। দুর্ঘটনাগুলো ১০৫৭টি (১৯.৬৭ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১৮১৩টি (৩৩.৭৫ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৫৬৬টি (২৯.১৫ শতাংশ) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৮২২টি (১৫.৩০ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১১৩টি (২.১০ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে। সংগঠনটি জানায়, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ০.৮৯ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ৪.২২ শতাংশ এবং আহত বেড়েছে ৩.৮৮ শতাংশ। আবার ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৩.৪৩ শতাংশ, প্রাণহানি বেড়েছে ১৫.৭০ শতাংশ আহত বেড়েছে ১.২০ শতাংশ। তবে ২০১৯, ২০২০ এবং ২০২১ এ তিন বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ছাড়া অন্যান্য দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় সমান। মূলত ক্রমবর্ধমান মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির কারণেই ২০২০ এবং ২০২১ সালের দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির মোট সংখ্যা বেড়েছে। মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোরও যুবক। এছাড়া মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ার কারণও উল্লেখ করেছে সংগঠনটি। এর মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার বিষয়টি প্রবল। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে নিজেরা দুর্ঘটনায় শিকার হচ্ছে এবং অন্যদের আক্রান্ত করছে। দেশে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় মোটরসাইকেল সংস্কৃতি চরমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এসব মোটরসাইকেল চালক সড়ক-মহাসড়কে বেপরোয়াভাবে চলাচল করছে। এদের বেপরোয়া মোটরসাইকেলের ধাক্কায় পথচারী নিহতের ঘটনাও বাড়ছে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার একটি ব্যাপক অংশ ঘটছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা এবং মুখোমুখি সংঘর্ষে। এসব দ্রুত গতির যানবাহনের চালকদের অধিকাংশই অদক্ষ ও অসুস্থ। তাদের বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর ফলে যারা সাবধানে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন তারাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। মোটরসাইকেল ৪ চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে।