মুসলমানদের দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আযহা সন্নিকটে। আগামী মাসের প্রথম দশকেই অনুষ্ঠিত হবে এ উৎসব। ঈদুল আযহার মূল আয়াজন পশু কুরবানি উপলক্ষে পুরোদমে প্রস্তুতি নিচ্ছেন ব্যাপারী ও খামারিরা। ব্যাপারীরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে গৃহস্থ ও খামারিদের কাছ থেকে গরু কিনছেন। অনেক গৃহস্থ ও খামারি সরাসরি হাটে নিয়ে গরু বিক্রির প্রস্তুতিও নিচ্ছেন। চলতি মাসের শেষের দিকেই জমে উঠবে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন পশুরহাট। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, দেশে এবারও পশুর সংকট নেই, আমদানির প্রয়োজন হবে না। তবে দেশের বিভিন্নস্থানের চলমান বন্যার কারণে কুরবানির পশুর হাট বসা বা কেনাবেচা কিছুটা হলেও বিঘœ ঘটবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ এখন গবাদি পশু রক্ষায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এ অবস্থায় অনেকেই কম দামে পশু বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে করে কোনো কোনো এলাকায় কুরবানির সময় গরুর দাম বেড়েও যেতে পারে। এছাড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছয় মাস আগে গো-খাদ্যের যে দাম ছিল, তা এখন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে অধিকাংশ গো-খাদ্যের দাম। ফলে এবার সার্বিকভাবে চড়া হতে পারে কুরবানির পশুর বাজার। অন্যদিকে পদ্মা সেতু চালু হলে পরিবহন খরচ কমে যাওয়ায় দাম বাড়বে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা যায়, গো-খাদ্যের দাম মণপ্রতি ২শ’ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। গরুর অন্যতম খাবার গমের ভুসি। এ ভুসির ৩৭ কেজির বস্তার দাম বেড়েছে ৪শ’ টাকা। আগে এক বস্তা ভুসির দাম ছিল ১৮শ’ টাকা। দাম বেড়েছে ধানের কুড়া ও গমের ছালেরও। বস্তাপ্রতি এ দুই ধরনের গো-খাদ্যের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা। সরিষার খৈল, ছোলার ভুসি, খেসারি, মাশকালাইয়ের ভুসিরও দাম বেড়েছে। গত ২১ মে বাজারে সরিষার খৈল বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫৫ টাকা, ছোলার ভুসি ৫৫, খেসারি ৫৬-৫৭ টাকা দরে। ২৮ বছর ধরে গরুর ব্যবসা করছেন ঝিনাইদহের মফিজ মিয়া। কয়েক মাস ধরে তিনি এলাকায় ঘুরে ঘুরে গরু কিনছেন। ঈদের আগে তিন-চার মাস খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট করে বিক্রি করবেন লাভে। ইতোমধ্যে দুই শতাধিক গরু কিনেছেন তিনি। তবে যেভাবে গো খাদ্যের দাম বেড়েছে তাতে গত বছরের তুলনায় পশুর দাম বাড়তে পারে। নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে বলেন, দেশে গরু আছে। গরুর সংকট নেই। যে গরু আছে, তা দিয়ে চাহিদা মেটানো সম্ভব। জানা গেছে, ব্যাপারীদের পাশাপাশি অনেক খামারি নিজেরাই গরু হাটে নিয়ে বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ‘সাদিক অ্যাগ্রো’ নামে একটি খামার রয়েছে ঢাকার মোহাম্মদপুরে। এ খামারে আসন্ন কুরবানির ঈদ ঘিরে দেড় হাজারের বেশি গরু প্রস্তুত করা হয়েছে। এখানে দেড় লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে। ১৪শ’ কেজি ওজনের ব্রাহমা জাতের একটি গরুর দাম হাঁকা হচ্ছে সর্বোচ্চ। বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এসব গরু কেনা হয় বলে জানালেন সাদিক অ্যাগ্রোর ইনচার্জ মো. মাঈনুল ইসলাম। তিনি বলেন, কুরবানির প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আমরা বড় গরু সংগ্রহ করেছি। তবে এবার দাম একটু বেশি পড়েছে। আমাদের খামারে আনার পরও খরচ বেশি পড়ছে। গো-খাদ্যের দাম বেশি, গরুর পেছনে খরচ বেড়েছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আসন্ন পবিত্র ঈদুল আযহায় দেশি পশু দিয়েই কুরবানির সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে সরকার। চলতি বছর দেশে ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার ৩৮৯টি কুরবানিযোগ্য পশু রয়েছে বলে তারা জানায। যা গত বছরের তুলনায় ২ লাখ ৭ হাজার বেশি। দেশীয় পশুতে চাহিদা পূরণ হওয়ায় দেশের বাইরে থেকে গরু আনা বন্ধে কঠোর অবস্থানে থাকবে সরকার। জানা গেছে, গত বছরের মতো এবারও গবাদিপশুর পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। চলতি বছর ১ কোটি ২১ লাখ ২৪ হাজার পশুর মধ্যে গরু ও মহিষের সংখ্যা ৪৬ লাখ ১১ হাজার ৩৮৩টি। গরু-মহিষের এ সংখ্যার মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট গবাদিপশু রয়েছে ৪২ লাখ ৪০ হাজার ৪৯৩টি আর গৃহপালিত গবাদিপশুর সংখ্যা ৩ লাখ ৭০ হাজার ৮৯০। ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৭৫ লাখ ১১ হাজার ৫৯৭, যার মধ্যে হৃষ্টপুষ্ট ছাগল-ভেড়া রয়েছে ৩৩ লাখ ৪৮ হাজার ৭৪০ আর গৃহপালিত গবাদি ছাগল-ভেড়ার সংখ্যা ৪১ লাখ ৬২ হাজার ৮৫৭। এছাড়া উট, দুম্বা ও অন্যান্য পশুর সংখ্যা ১ হাজার ৪০৯টি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জিনাত সুলতানা গণমাধ্যমকে বলেন, দেশের আর্থিক স্বাস্থ্য এবার ভালো। আশা করছি, গত বছরের তুলনায় ১০ শতাংশ বাড়তি চাহিদা হবে। তবে চাহিদা বাড়লেও গরুর সংকট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। দেশের খামারে পর্যাপ্ত গরু প্রস্তুত আছে। আশা করি, কুরবানিতে চাহিদা মিটিয়েও গরু মজুত থাকবে। কোনোভাবেই বিদেশ থেকে গরু আনার প্রয়োজন হবে না।
আসন্ন পবিত্র ঈদুল আযহায় কুরবানির জন্য আট বিভাগের ৬ লাখ ৮১ হাজার ৫৩২টি খামারের তথ্য অনুযায়ী পশুর পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছর খামারিদের কাছ থেকে হৃষ্টপুষ্ট পশু আসবে ঢাকা থেকে ৬ লাখ ৩৭ হাজার ১৯৬টি, চট্টগ্রাম থেকে ১৫ লাখ ১২ হাজার ১১৪, রাজশাহী থেকে ২৭ লাখ ২৮ হাজার ৪৬০, খুলনা থেকে ৮ লাখ ৭৯ হাজার ২৫১, বরিশাল থেকে ৩ লাখ ৭৪ হাজার ৫৪৩, সিলেট থেকে ১ লাখ ৬৬ ৩৫৩, রংপুর থেকে ১০ লাখ ৩ হাজার ২৮১ ও ময়মনসিংহ থেকে আসবে ২ লাখ ৯ হাজার ৩৪৪টি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর পবিত্র ঈদুল আযহায় সারাদেশে ৯০ লাখ ৯৩ হাজার পশু কুরবানি হয়েছে। যার মধ্যে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার ৬৭৯টি গরু-মহিষ, ৫০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৮টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৭১৫টি গবাদিপশু কুরবানি হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন। গবাদিপশুর বৃহৎ একটি অংশ পাবনা, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর ও যশোর অঞ্চল থেকে ঢাকার ওপর দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যায়। পরিবহন খরচ কিন্তু উল্লেখযোগ্য অংশ, তাদের ট্রাক আগে যেখানে তিন-চারদিন ফেরির অপেক্ষায় থাকত। এবার সেসব সমস্যা আমাদের থাকবে না, নির্বিঘেœ পশু পরিবহন হবে। পরিবহন খরচটা মিনিমাইজ হবে। খাদ্যমূল্য কিছুটা বেশি হলেও কুরবানির পশুর দাম সেভাবে বাড়ার কথা নয়। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ৯ লাখ ৭৩ হাজার ৮৩৩টি গরু-মহিষ, ১২ লাখ ৬৫ হাজার ৫৬টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৩৬৩টিসহ মোট ২২ লাখ ৩৯ হাজার ২৫২টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ১০ লাখ ৭১ হাজার ২৩১টি গরু-মহিষ, ৮ লাখ ২৮ হাজার ৮৬টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ২০১টিসহ মোট ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫১৮টি, রাজশাহী বিভাগে ৬ লাখ ১৬ হাজার ৭৩৩টি গরু-মহিষ, ১২ লাখ ১৬ হাজার ২৮৩টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ১২৯টিসহ মোট ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ১৪৫টি, খুলনা বিভাগে ২ লাখ ৩৯ হাজার ১৪৭টি গরু-মহিষ, ৬ লাখ ১৮ হাজার ৪৪৩টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ১১টিসহ মোট ৮ লাখ ৫৭ হাজার ৬০১টি।
বরিশাল বিভাগে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৬২১টি গরু-মহিষ, ১ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৮টি ছাগল-ভেড়াসহ মোট ৪ লাখ ৬১ হাজার ৯৭৯টি, সিলেট বিভাগে ২ লাখ ৯ হাজার ৫৬৯টি গরু-মহিষ, ১ লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৪টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য ৮টিসহ মোট ৪ লাখ ৮ হাজার ৯৪১টি, রংপুর বিভাগে ৪ লাখ ৯৬ হাজার ২২০টি গরু-মহিষ, ৫ লাখ ৪৮ হাজার ৬৩৯টি ছাগল-ভেড়াসহ মোট ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৮৫৯টি এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ লাখ ৮০ হাজার ৩২৫টি গরু-মহিষ, ১ লাখ ৬৭ হাজার ৬১৯টি ছাগল-ভেড়া ও অন্যান্য তিনটিসহ মোট ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯৪৭টি গবাদিপশু কুরবানি হয়েছে।
২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার গরু-মহিষ, ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার ছাগল-ভেড়া এবং অন্যান্য ৪ হাজার ৭৬৫ পশুসহ মোট ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি কুরবানিযোগ্য গবাদিপশু ছিল। ২০২০ সালের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫০০টি। এর মধ্যে প্রায় ৯৪ লাখ ৫০ হাজার ২৬৩টি পশু কুরবানি করা হয়েছিল।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহাজাদা বলেন, চলতি বছর কুরবানিযোগ্য পশু রয়েছে ১ কোটি ২১ লাখের বেশি, যা চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত। ধারণা করছি গতবারের তুলনায় এবার কুরবানি বেশি হবে। গত বছর করোনাসহ অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যেও কিন্তু প্রায় ৯১ লাখ গবাদিপশু কুরবানি হয়েছে, এবার হয়তো তার চেয়ে বেশিই হবে। চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে গবাধি পশুর আনা নেয়ায় কিছুটা সমস্যা হতে পারে বলে তিনি জানান। মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, পশুর দাম বেশি থাকবে আমি সেভাবে এটি বলতে চাই না। ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু হলে ওই অঞ্চল থেকে আসা পশুর ভাড়া অনেকাংশে কমে যাবে। যার প্রভাব বিক্রির ক্ষেত্রেও পড়বে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, কুরবানির জন্য পর্যাপ্ত পশু মজুত আছে, তাই এ বছরও কুরবানিতে বাইরের দেশ থেকে একটি পশুও আসবে না। আমাদের যে পরিমাণ পশু উৎপাদন হচ্ছে সেটি চাহিদা মিটিয়েও উদ্বৃত্ত থাকে। গত বছর কুরবানিতে উৎপাদিত গরুর এক-দশমাংশ পশু বিক্রি হয়নি। এর সঙ্গে চলতি বছরের জন্য উপযুক্ত পশু মিলে অনেক পশু খামারিদের হাতে রয়েছে। দেশের খামারি এবং গৃহস্থের কাছে থাকা গবাদি পশু দিয়ে প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হবে। তিনি আরো বলেন, চলতি বছর করোনা পরিস্থিতি ভালো থাকায় খামারিদের গরু নিয়ে ফিরে যেতে হবে না। উপযুক্ত দামেই গরু বিক্রি করতে পারবেন।
এদিকে পশুর খামারিরা আশা করছেন, গত বছরের তুলনায় এবার কুরবানির পশুর দামও ভালো পাবেন তারা। তাদের আশা গত বছর অনেক পশু অবিক্রীত রয়ে গেছে। সেসব পশুর তারা এবার বিক্রি করতে পারবেন। গরুর খামারি পলাশ বলেন, দুইটি খামারে তার প্রায় দুই শতাধিক গরু আছে। পশু খাদ্যের দাম বাড়ায় দিন দিন খরচ বাড়ছে। তবে তার আশা সবগুলো গরু বিক্রি হবে। এতে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।