দুই দশকের মধ্যে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংক বা সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সর্বোচ্চ অর্থ জমা হয়েছে গত বছর। বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে এসব অর্থ জমা হয়েছে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে। ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ। প্রতি সুইস ফ্রাঁর বিনিময় মূল্য ৯৫ টাকা ধরে হিসাব করলে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। অথচ গত ২০২০ সালে সেখানকার ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা রাখা অর্থের পরিমাণ ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ বেড়েছে।
সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) গত বৃহস্পতিবার ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০২১’ বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখান থেকে বাংলাদেশিদের অর্থ জমার এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে পাচার সম্পর্কে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি আমানত হিসেবে কার কত অর্থ আছে, তা-ও জানা যায়নি। কখনই এ তথ্য প্রকাশ করে না এসএনবি।
২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ, ২০১৭ সাল শেষে এই অর্থের পরিমাণ কমে হয় ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০১৮ সাল শেষে এই অর্থের পরিমাণ কমে হয় ৬১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০১৯ সালে আরও খানিকটা কমে দাঁড়ায় ৬০ কোটি ৩০ লাখে। ২০২০ সাল শেষে নেমে আসে ৫৬ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁয়। সবশেষ ২০২১ সালে এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ৫৫ শতাংশ বেড়ে এক লাফে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁতে উঠেছে।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশের মানুষের মত সুইস ব্যাংকে ভারতীয় নাগরিকরাও বেশি অর্থ জমা করেছেন। এই এক বছরে ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে উঠেছে।
২০২০ সাল শেষে ব্যাংকটিতে ভারতীয়দের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল ২৫৫ কোটি ২৬ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০২১ সালে তা ৫০ শতাংশ বেড়ে ৩৮২ কোটি ৮৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ হয়েছে। ২০১৯ সালে ছিল ৮৯ কোটি ৯০ লাখ। পাকিস্তানের নাগরিকদের আমানতও বেড়েছে। ২০২০ সালে ছিল ৬৪ কোটি ২২ লাখ সুইস ফ্রাঁ। ২০২১ সাল শেষে হয়েছে ৭০ কোটি ৫৯ লাখ ফ্রাঁ।
সুইজারল্যান্ডের ২৪৩টি ব্যাংকের যে হিসাব দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক দিয়েছে, তাতে একক দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের জমা অর্থের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। পরের অবস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের নাম। তালিকায় এর পরে রয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ফ্রান্স, হংকং, জার্মানি, সিঙ্গাপুর ও লুক্সেমবুর্গের নাম।
বাংলাদেশ থেকে নানাভাবে অবৈধ উপায়ে পাচার হওয়া অর্থ যেমন সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে জমা হয়, তেমনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাদেশিরাও দেশটিতে অর্থ জমা রাখেন। তাই সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশিদের মোট অর্থের মধ্যে বৈধ-অবৈধ সব অর্থই রয়েছে। সাধারণত সুইস ব্যাংক অর্থের উৎস গোপন রাখে। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকেরা দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে অর্থ জমা রাখেন।
সুইজারল্যান্ডের আইনে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয় বা টাকার উৎসও তারা জানতে চায় না। এই গোপনীয়তার নীতির কারণে সারা বিশ্বের ধনী ব্যক্তিরা সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন। তবে কোন দেশের গ্রাহকদের কী পরিমাণ অর্থ সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে জমা আছে, তার একটি ধারণা প্রতি বছর এসএনবির বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে পাওয়া যায়। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদের বাধ্যবাধকতা মেনে এসএনবি ওই তথ্য প্রকাশ করে। তবে সেখানে গ্রাহকের বিষয়ে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না।
দেশে দুর্নীতি প্রতিরোধ ও সুশাসন নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের যে টাকা জমা রয়েছে, তার বেশির ভাগটাই অবৈধভাবে অর্জিত। বিদেশি ব্যাংক বিশেষ করে সুইস ব্যাংকে পাচার করা ‘বিপুল পরিমাণ’ অর্থ উদ্ধারের যথাযথ পদক্ষেপের নির্দেশনা চেয়ে গত বছর একটি রিট আবেদন হয়েছে হাইকোর্টে। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আদালত সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের কতজনের কত টাকা আছে সেই তালিকা চেয়েছিল সরকারের কাছে। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে তাও জানতে চাওয়া হয়।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অর্থের পরিমাণ প্রথমবার ১০ কোটি সুইস ফ্রাঙ্ক ছাড়িয়ে যায় ২০০৬ সালে, যেটি ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শেষ বছর। ৯ কোটি ৭২ লাখ সুইস ফ্রাঁ থেকে বেড়ে ওই বছর জমার পরিমাণ দাঁড়ায় ১২ কোটি ৪৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ। সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রথম বছর ২০০৭ সালে জমা অর্থের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে ২০ কোটি ৩০ লাখ সুইস ফ্রাঁ হয়।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১১ সালে জমার পরিমাণ ছিল ১৫ কোটি ২৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ, তা ধারাবাহিকভাবে বেড়ে ২০১৬ সালে দাঁড়ায় ৬৬ কোটি ১৯ লাখে। তবে ২০১৭ সালে তা কমে ৪৮ কোটি ১৩ লাখ সুইস ফ্রাঙ্কে নেমে এলেও ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনের বছরে তা বেড়ে ৫১ কোটি ৭৭ লাখ সুইস ফ্রাঙ্কে দাঁড়ায়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অতীত অভিজ্ঞতা ও তথ্য-উপাত্ত থেকে আমরা দেখেছি, নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যায়। আগে বাণিজ্যের আড়ালে বাণিজ্য পুঁজি পাচার হতো। এখন আর্থিক পুঁজি পাচার হচ্ছে। আর এ কাজের সঙ্গে জড়িত দুর্নীতি চক্রের আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটেছে। পাশাপাশি সরকারি নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তারা প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। এ কারণে পাচারের অর্থ নামমাত্র করে দেশে ফিরিয়ে আনতে বাজেটীয় প্রস্তাব দেওয়া হয়। বলা চলে, দুর্নীতির আন্তর্জাতিকীকরণ চক্রের হাতে এখন নীতিও ছিনতাই হয়ে গেছে।