চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীতে বেসরকারি বিএম কন্টেইনার ডিপোর আগুন ও ভয়াবহ বিস্ফোরণের এক সপ্তাহ পরেও আগুন লাগার কারণ জানা যায়নি। প্রাথমিকভাবে কন্টেইনারে থাকা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে বলা হলেও এর পেছনে অন্য কোন কারণ আছে কি না তাও এখনও স্পষ্ট নয়। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ছাড়া সেখানে আর কোন কোন ধরনের রাসায়নিক ছিলো তাও এখনো অজানা।
ডিপোর কর্মকর্তা কর্মচারী এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের কেউ বলছেন, ডিপোর ল্যান্ডিং পয়েন্টে থাকা একটি কেমিক্যাল তথা হাইড্রোজেন পার অক্সাইডের কন্টেইনার থেকে প্রথমে ধোঁয়া বের হয়। এরপর সেখান থেকে আগুনের সূত্রপাত। পরে তা আশপাশের কন্টেইনারে ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে আগুন নেভাতে শুরু করেন। এক পর্যায়ে কেমিক্যাল ভর্তি কন্টেইনারে পানি পড়তেই ঘটে ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ।
তাতে ব্যাপক প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে। ডিপো কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি সরকারের দায়িত্বশীলদের কেউ কেউ এই ঘটনার পেছনে নাশকতা থাকতে পারে বলেও সন্দেহ করেছেন। যদিও কর্তৃপক্ষ তাদের বক্তব্যের পক্ষে কোন তথ্য, প্রমাণ এখনও উপস্থাপন করতে পারেনি। আবার পুলিশের দায়ের করা মামলাতেও নাশকতার কোন ধারা নেই। বরং অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে জামিনযোগ্য ধারায় মামলা রেকর্ড করা হয়েছে। এ অবস্থায় স্মার্ট গ্রুপের সহযোগী ও আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমানের মালিকানাধীন এ ডিপোতে আগুন এবং ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে প্রকৃত রহস্য এখনও অজানাই থেকে গেছে। তবে এ রহস্য উদঘাটনে মাঠে একাধিক তদন্ত কমিটি। সরকার গঠিত একাধিক কমিটির পাশাপাশি থানা পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি তদন্ত অব্যাহত রেখেছে। তারা আগুনের উৎস এবং কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি এটি নিচক দুর্ঘটনা না কি নাশকতা তাও খতিয়ে দেখছে। এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে অন্তত পাঁচটি তদন্ত কমিটি ডিপো পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় তথ্য, আলামত সংগ্রহ করেছে। গতকাল শনিবার সিআইডির একটি টিম তৃতীয় দিনের মতো ডিপো পরিদর্শন করে আরো বেশকিছু আলামত জব্দ করে। প্রায় ২৬ একর জমিতে গড়ে উঠা বিরাট এ ডিপো ১১৮টি সিসিটিভি ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হতো। এসব ক্যামেরার তথ্য সংরক্ষিত হতো সাতটি ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডিং (ডিভিআর) মেশিনে। সিআইডি ডিভিআর মেশিনগুলো জব্দ করেছে।
সিআইডি চট্টগ্রামের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহনেয়াজ খালেদ ইনকিলাবকে বলেন, ডিপোতে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়াদের লাশ শনাক্ত এবং নিখোঁজদের পরিচয় নিশ্চিতে ডিএনএ টেস্ট করছি আমরা। এর পাশাপাশি আগুনের উৎস ও কারণ জানতে যাবতীয় ফরেনসিক টেস্টও করা হচ্ছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে সিআইডির ল্যাবে এসব পরীক্ষা করা হবে। মামলাটি এখনও পুলিশ তদন্ত করছে। তবে পুলিশকে মামলার তদন্তকাজে সহযোগীতা করছে সিআইডি।
জানা গেছে, সিআইডি তিন দফা ডিপো থেকে নানা আলামত জব্দ করে। এসব আলামত পরীক্ষা করে আগুন লাগার কারণ এবং ভয়াবহ বিস্ফোরণ কেন ঘটেছে তা নিশ্চিত করা হবে। গতকাল বেলা ১১টায় সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ শরীফের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল ডিপোর ভেতরে ক্ষতিগ্রস্ত আইটি কক্ষে যায়। ওই কার্যালয় থেকে পুরো কন্টেইনার ডিপোর আইটি সিস্টেম এবং সিসি ক্যামেরাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হতো। সেখানে থেকে তারা বিভিন্ন ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর উদ্ধার করা ডিভিআর মেশিনের পোড়া অংশগুলো জব্দ করে। সিআইডির একজন কর্মকর্তা জানান, এসব আলামত থেকে আগুনের সূত্র সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মিলতে পারে।
ডিপোতে আগুন এবং বিস্ফোরণের ঘটনায় সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ ডিপোর মূল মালিকদের বাদ দিয়ে আট কর্মকর্তাকে আসামি করে মামলা করে। মামলার প্রায় সব আসামি আগুনে দগ্ধ এবং আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর অভিযোগে দায়েরকৃত মামলাটির তদন্তভার দেয়া হয়েছে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিককে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম আজাদ ইনকিলাবকে বলেন, মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। তদন্তে আগুন লাগার কারণ তথা আগুনের উৎস খুঁজে বের করা হবে। এই ঘটনায় কারা জড়িত কিংবা কাদের অবহেলায় ঘটনা তাও বের করা হবে।
পুলিশের পাশাপাশি আরো ছয়টি তদন্ত কমিটি কাজ করছে। ফায়ার সার্ভিস, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশন, জেলা প্রশাসন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষ গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা ইতোমধ্যে ডিপো পরিদর্শন করে আলামত সংগ্রহ করেছেন। এসব কমিটিও আগুন লাগার কারণ, ক্ষয়ক্ষতি এবং ডিপো ব্যবস্থাপনায় কোন অনিয়ম থাকলে তা বের করবে। সেই সাথে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কারা তাদের চিহ্নিত করবে।
এদিকে গতকালও ডিপোর সামনে নিখোঁজ কয়েকজনের স্বজনকে ছবি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। ঘটনার পর থেকে নিখোঁজদের খুঁজছেন তাদের স্বজনেরা। এখন ডিপোর আগুন নেভায় তারা ডিপোর লোকজনের কাছে নিখোঁজদের তথ্য জানতে সেখানে ছুটে যায়। তবে এ বিষয়ে তারা কোন সহযোগীতা পাননি। থানার ওসি আবুল কালাম আজাদ বলেন, অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। আবার এখনও ১৯ জনের লাশ শনাক্ত করা যায়নি। নিখোঁজদের লাশ এখানে থাকতে পারে। নিখোঁজ যারা তাদের স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিবেদন আসলে লাশ শনাক্ত করা যাবে।
অপরদিকে গতকাল তৃতীয় দিনের মতো ডিপোতে ধ্বংসস্তুপ সরানোর কাজ চলছে। ডিপো কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব লোকবল ও যন্ত্রপাতি দিয়ে এগুলো সরাচ্ছে। তারা বলছেন, পোড়া ধ্বংসস্তপ সরিয়ে নিয়ে পুরোপুরি কাজের উপযোগী করতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে যাবে। ডিপোর বাইরে ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) ও শিপিং কোম্পানিগুলোর প্রতিনিধিরা ভিড় করছেন। গত ৪ জুন রাতে ডিপোতে আগুন থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অর্ধশতাধিক মানুষের প্রাণহানী হয়। আহত চারশ জনের মধ্যে এখনো ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে হাসপাতালে আছেন দেড়শ জন।