দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর শ্রমবাজার চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়া। নতুন সিদ্ধান্ত অনুসারে চলতি জুনেই বাংলাদেশ থেকে কর্মী যাওয়া শুরু করবে মালয়েশিয়ায়। গতকাল ঢাকায় যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্তের কথা জানান প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ। বৈঠক উপলক্ষে বুধবার রাতে ঢাকায় আসেন মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী এম সারাভানান।
গতকাল সকালে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে শুরু হয় যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক। এতে দুই দেশের মন্ত্রীরা নিজ নিজ প্রতিনিধি দলের পক্ষে নেতৃত্ব দেন। বৈঠকে শেষে বিকালে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, ‘আমি মন্ত্রী হওয়ার পর ভেবেছিলাম মালয়েশিয়ার বাজারে কর্মী পাঠাতে পারব না। হয়তো ব্যর্থ হয়েই বাড়ি ফিরব। কিন্তু আজ একটি সমঝোতায় এসেছি। জুনের মধ্যে কর্মী পাঠানো শুরু করব। মালয়েশিয়া পাঁচ বছরে ৫ লাখ লোক নেওয়ার কথা বলেছে। তাদের ইচ্ছা প্রথম বছরে ২ লাখ যাবে। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে ওদের যত কর্মীর চাহিদা, তাতে প্রথম বছরই ৫ লাখ লোক যাবে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আজ আমাদের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারা বন্ধ সেক্টরগুলো ওপেন করবে। বেতন ১৫০০ রিঙ্গিত হবে। তাদের কর্মী তালিকা দেওয়া হবে, সেখান থেকে যাবে। তাদের সিলেকশন অনুযায়ী মেডিকেল হবে।’
অভিবাসন খরচ প্রসঙ্গে মন্ত্রী বলেন, ‘খরচ সমঝোতায় উল্লেখ করা আছে। কিছু অংশ বাংলাদেশের প্রান্তে খরচ আছে, তা কর্মীকে বহন করতে হবে। আর বিমান টিকিট থেকে শুরু করে বাদবাকি যাবতীয় খরচ নিয়োগকর্তার। আগের সমঝোতায় বিমান টিকিট একটি ছিল আর এখন আসা-যাওয়া দুটির খরচ নিয়োগকর্তার। মালয়েশিয়ার মন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন, শূন্য অভিবাসন ব্যয় নিশ্চিত করার জন্য তাঁরা কাজ করে যাবেন। যদি কোনো এজেন্সি বা নিয়োগকর্তা আইন ভঙ্গ করেন তাহলে আইনি ব্যবস্থা নেবেন তাঁরা। আশা করছি আগের যে হিসাব ১ লাখ ৬০ হাজারের কথা ছিল এবার তার চেয়ে কম হবে। যাওয়া-আসার টিকিট, মালয়েশিয়ায় কভিড-১৯ টেস্ট, কোয়ারেন্টাইন, থাকা-খাওয়াসহ বিভিন্ন খরচ নিয়োগদাতা বহন করবেন। বাংলাদেশের অংশে পাসপোর্ট, মেডিকেলসহ অন্যান্য খরচ কর্মীকে বহন করতে হবে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘কোনো সিন্ডিকেট নয়, আমরা দেশের সব বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সির তালিকা পাঠিয়েছি। বাংলাদেশে এখন বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সি আছে ১ হাজার ৫২০টি। আমরা কিন্তু এ তালিকা তাদের পাঠিয়েছিলাম। একটা কথা মনে রাখতে হবে, সমঝোতা অনুযায়ী রিক্রুটিং এজেন্ট নির্বাচনের অধিকার মালয়েশিয়ার। যেহেতু তারা লোক নেবে সেহেতু অধিকার তাদের। এই যে ২৫, ৫০, ১০০ সংখ্যা আপনারা বলেন এ সংখ্যা সমঝোতায় নেই, আমাদের আজকের আলোচনায় কোথাও নেই। রিক্রুটিং এজেন্ট যারা ব্যবসা করতে চান তারা নিজেরাই নিজের ব্যবসা খুঁজবেন।’
সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন বলেন, ‘চমৎকারভাবে বৈঠক হয়েছে। আমরা যে সমঝোতা স্মারক সম্পাদন করেছি তা বাস্তবায়নের জন্য প্রথম জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিং ছিল এটি। সমঝোতা স্মারকে যে পদ্ধতি বর্ণনা করা আছে, বাংলাদেশ তাদের রিক্রুটিং এজেন্সির লিস্ট দেবে। তারা তাদের নিয়ম অনুযায়ী বাছাই করবে।’ সচিব বলেন, আগামী এক বছরের মধ্যে অন্তত ২ লাখ মানুষ মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ইকোনমিক সেক্টরে যাবে। একই সঙ্গে নতুন অনেক সেক্টর আছে যেগুলো এখনো চালু হয়নি, বাংলাদেশের জন্য সেগুলো চালু করতে তাঁরা আন্তরিকভাবে চেষ্টা করবেন। একটি হচ্ছে নিরাপত্তা কর্মী, অন্যটি গৃহকর্মী। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএমইটি মহাপরিচালক মো. শহীদুল আলম প্রমুখ।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্যানুযায়ী সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের পর মালয়েশিয়াই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। ১৯৭৮ সাল থেকে প্রায় ১০ লাখ ৫৭ হাজার কর্মী বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় গেছেন। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে সে বছরই ১ লাখ ৭৫ হাজার কর্মী গেছেন মালয়েশিয়ায়। এর আগের তিন বছরে মালয়েশিয়ায় কাজ নিয়ে ১ লাখ ৭০ হাজার কর্মী গেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে এ বছরের এপ্রিল পর্যন্ত মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশি অভিবাসীরা প্রায় ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন।
মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভানান গতকাল জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের পাশাপাশি গণভবনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গেও বৈঠক করেছেন তিনি।
কর্মী পাঠাতে সব প্রটোকল মানার নিশ্চয়তা প্রধানমন্ত্রীর : মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠাতে প্রয়োজনীয় সব নিয়মকানুন, ভ্যাকসিনেশনসহ প্রটোকল মেনে চলর নিশ্চয়তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ নিশ্চয়তা দেন। যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আশা করি দুই পক্ষই নিরাপদ ও স্বল্প অভিবাসন ব্যয় নিশ্চিতে কাজ করবে।’ বাংলাদেশ থেকে বেসামরিক কর্মকাণ্ডের জন্য নিরাপত্তা কর্মী নিতে মালয়েশিয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মালয়েশিয়ার মন্ত্রী এম সারাভানান প্রধানমন্ত্রীকে জানান, মালয়েশিয়ার সব নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আইএলও গাইডলাইন মেনেই করা হচ্ছে। এ ছাড়া অভিবাসী কর্মী নিয়োগে মালয়েশিয়ার পাঁচ বছরের অ্যাকশন প্ল্যানের কথা জানিয়ে অতিথি মন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে মালয়েশিয়ায় কর্মীদের বেতন বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ রিঙ্গিত করা হয়েছে। কর্মীদের বেতন দেওয়ার প্রক্রিয়াও করা হয়েছে পুরোপুরি ডিজিটাল। ফলে বেতন সরাসরি মালিকের কাছ থেকে কর্মীদের কাছে চলে যাবে। এর মধ্যে রিক্রুটিং এজেন্টের কোনো স্থান নেই।