৫০ বছর বয়সী সিরাজ। এবারের ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। কুমিল্লা থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য আনা হয় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে। পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ঈদ আনন্দ বিষাদে পরিণত হয় পুরো পরিবারের। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া এলাকার হৃদয় হাসান (২৬) ঈদের পরদিন ১৮ জন বন্ধু মিলে মোটরসাইকেলে করে সিলেটের উদ্দেশে ঘুরতে বের হন। দুর্ঘটনায় পড়ে তার ঠাঁই হয়েছে পঙ্গু হাসপাতালে। একটি পা কেটে ফেলতে হয়েছে। সঙ্গে থাকা বন্ধুর অবস্থাও আশঙ্কাজনক।
করোনাভাইরাস সংক্রমণে দেশে মৃত্যু থামলেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা বেড়েই চলেছে। এবার ঈদের ছুটির চার দিনে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় কেবল ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালেই মারা গেছেন ৬০ জন। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮ শতাধিক। অধিকাংশই বয়সে তরুণ। বেঁচে থাকা অনেকের হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে হু হু করে বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এবার ঈদুল ফিতরে লাখ লাখ মানুষ মোটরসাইকেলে বাড়ি ফেরেন। ঈদের সময় তিন দিনে ২১ হাজার ৩৬০টি মোটরসাইকেল বঙ্গবন্ধু সেতু পারাপার হয়, যা ১৯৯৮ সালে সেতুটি চালুর পর রেকর্ড। ২ মে থেকে ৭ মে পর্যন্ত ৬ দিনে সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে ১ হাজার ২৫০ জনের বেশি রোগী ভর্তি হন। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভর্তি রোগীদের ৩০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। অনেকেরই হাত-পা কেটে ফেলতে হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে হাসপাতালটিতে দৈনিক দেড় শ জনের মতো রোগী এলেও ঈদের সময় রোগীর সংখ্যা পৌঁছে যায় ২০০ থেকে ২৫০ জনে। ২ মে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ১৯৭ জন হাসপাতালে আসেন। তাদের মধ্যে সংকটাপন্ন অবস্থায় ৬৫ জনের অস্ত্রোপচার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এদিকে দুর্ঘটনা এড়াতে মোটরসাইকেল চালকদের জন্য নতুন নির্দেশনা দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। বিজ্ঞপ্তিতে ফুলহাতা শার্ট, ফুলপ্যান্ট, কেডস বা জুতাসহ মানসম্মত নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরে মোটরসাইকেল চালানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। বিআরটিএর তথ্যানুযায়ী, সাড়ে ৩৬ লাখ মোটরসাইকেল নিবন্ধন করা হলেও দেশে নিবন্ধিত চালকের সংখ্যা সাড়ে ২৩ লাখ। অর্থাৎ ১৩ লাখ মোটরসাইকেল চালক রয়েছেন, যাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অন্যদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) গবেষণায় দেখা গেছে, মোটরসাইকেলের কারণে সড়কে দুর্ঘটনার হার ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে সড়কে যত হতাহতের ঘটনা ঘটছে, এর ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণে হচ্ছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ঈদুল ফিতরের ছুটির আগে-পরের দুই সপ্তাহে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩২৩ জন নিহত হন। নিহতের ৪৩ শতাংশই ছিলেন মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। নিহতদের বড় অংশই ছিল কিশোর-তরুণ। সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এবারের ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান দু-এক দিনের মধ্যে আমরা চূড়ান্ত করব।
তবে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে নিশ্চিত হয়েছি, গণমাধ্যমে আসা খবরের চেয়ে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে আরও অনেক বেশি। দুর্ঘটনায় পড়ে পঙ্গু হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিকেলেই প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৪৫০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। সারা দেশে এই সংখ্যা ২ হাজারের মতো। এর মধ্যে ৩৫-৪০ ভাগই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার। সব খবর পত্র-পত্রিকায় আসছে না।’
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে ২ হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা যান ২ হাজার ২১৪ জন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ এবং এ দুর্ঘটনাগুলোতে মৃত্যু ৫১ শতাংশ বেড়ে যায়। এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, ‘মোটরসাইকেল অন্যান্য যানবাহনের চেয়ে ৩০ গুণ ঝুঁকিপূর্ণ। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর ওপর নানা বিধিনিষেধ দেওয়া হয়। এখানে যেভাবে মোটরসাইকেল বাড়তে দেওয়া হচ্ছে, এটা আত্মঘাতী। আমরা তরুণ প্রজন্ম হারাব। যারা বেঁচে থাকবে, তারা পঙ্গুত্ব বরণ করে নিজের, পরিবারের ও দেশের জন্য অভিশাপ হয়ে বেঁচে থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘মোটরসাইকেল চালানো এক ধরনের আসক্তির মতো। এর ডিজাইনও করা হয় তরুণদের আকর্ষণ করার উপযোগী করে, যে কারণে যারা মোটরসাইকেল চালান, তাদের প্রাইভেট কার দিলেও চালাতে চান না। মেট্রো দিলেও তাতে তারা চড়বেন না। ২০১৬ সাল থেকে এই বাহন নিয়ন্ত্রণের কথা বলছি। কাজ হয়নি। নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান বিআরটিএ শুধু সুন্দর সুন্দর বাণী দিয়েই দায়িত্ব শেষ করছে। এখন ৩০০ সিসি বাইকের অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে। অফিসে যেতে তো ৩০০ সিসির বাইক দরকার নেই। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় হতাহতের জন্য সরকার ও দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো সমান দায়ী।’