মানুষের যানমালের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে অবৈধ ‘মোবাইল নেটওয়ার্ক জ্যামার’। এই ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে যে কেউ চাইলেই বন্ধ করে দিতে পারছে একটি নির্দিষ্ট এলাকার মোবাইল নেটওয়ার্ক। ফলে ওই এলাকায় কোনো অপরাধ ঘটলেও মোবাইলে জানানো যাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। অপরাধীরা নিজেদেরকে আড়াল করতেও ব্যবহার করছে জ্যামার। সেই সঙ্গে যত্রতত্র জ্যামারের অবৈধ ব্যবহারে বিঘ্ন ঘটছে মোবাইল নেটওয়ার্কে। মোবাইল অপারেটরদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) এসব ডিভাইস বিক্রি ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করলেও নেটওয়ার্ক বিভ্রাট কাটছে না। গতকালও বিভিন্ন অনলাইন শপে প্রকাশ্যে বিক্রি করতে দেখা গেছে নিষিদ্ধ বেতার যন্ত্রপাতি। নিরাপত্তা ঝুঁকি ও মোবাইল অপারেটরদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি এপ্রিলে মোবাইলে খুদে বার্তার মাধ্যমে অবৈধভাবে ইনস্টল করা জ্যামার, নেটওয়ার্ক বুস্টার ও রিপিটার সরিয়ে ফেলতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানাতে শুরু করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা- বিটিআরসি। সেই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে চলছে অভিযান। এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেছেন, ‘অবৈধ জ্যামার, বুস্টার-রিপিটার ব্যবহারে রাজধানীতেই সহস্রাধিক স্থানে মোবাইল নেটওয়ার্ক বিঘিœত হচ্ছে বলে আমরা জানতে পেরেছি। এ জন্য সবাইকে বার্তা পাঠিয়ে এগুলো খুলে ফেলতে বলা হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানও চলবে।’ তবে এখনো প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে এসব নিষিদ্ধ বেতার সরঞ্জাম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার বিভিন্ন প্রয়োজনে নেটওয়ার্ক জ্যামার ব্যবহার করে। চোরকারবারি ঠেকাতে বর্ডারে, সরকারের স্পর্শকাতর স্থান, জেলখানায়, কখনো আবার মোবাইলের মাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে পড়া রোধেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জ্যামার ব্যবহার করে। অন্যদিকে সন্ত্রাসী, চোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারীরাও জ্যামার ব্যবহার করছে অপরাধকর্মে। কোনো বাড়িতে চুরি বা ডাকাতির আগে আশপাশে জ্যামার বসিয়ে দিলে ভুক্তভোগীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে পারবে না। সন্ত্রাসীরা কোথাও হামলার আগে জ্যামার বসিয়ে দিতে পারে। ছিনতাইকারীরা পোর্টেবল জ্যামার ব্যবহার করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে। অপহরণকারীরাও নিজের অবস্থান লুকাতে জ্যামার ব্যবহার করতে পারে। অনেক জ্যামার সংশ্লিষ্ট এলাকার পুরো নেটওয়ার্ক ব্লক করে দেয়। এ ছাড়া অনেকে নিজের নেটওয়ার্ক বাড়াতে নেটওয়ার্ক বুস্টার ও রিপিটার ব্যবহার করছে। এতেও অন্য গ্রাহকের মোবাইল নেটওয়ার্ক বিঘিœত হচ্ছে। নিষিদ্ধ হলেও প্রকাশেই এগুলো বিক্রি হচ্ছে। শুধু ব্যবহার বা বিক্রি নয়, এসব ডিভাইস আমদানি ও বহন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
ঘটনা-১ : ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর উত্তরায় নিষিদ্ধ সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) তিন সদস্যকে জ্যামারসহ গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতেই তারা জ্যামার ব্যবহার করত। ঘটনা-২ : ২০১৮ সালের ২৬ এপ্রিল। রাজধানীর কাকরাইলে তাবলিগ জামাতের প্রধান কেন্দ্রের (মারকাজ) নিয়ন্ত্রণ নিয়ে মুখোমুখি দুই পক্ষ। যে কোনো সময় সংঘর্ষের আশঙ্কা। তখন মারকাজে অবস্থান করছিলেন অনেক বিদেশি। রাত ৯টার দিকে ঘটনাস্থলে যান রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোহাম্মদ মোশাররফ। পুরো বিষয়টি মুঠোফোনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে গিয়ে দেখেন কারও মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। তল্লাশি চালিয়ে মারকাজের দক্ষিণ পাশের ভবনের তৃতীয় তলায় খুঁজে পান দুটি জ্যামার। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, গোপনে জ্যামার দুটি বসিয়েছিলেন এক প্রকৌশলী। এ ঘটনায় তখন রমনা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় বলা হয়, সংশ্লিষ্টরা ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩) ধারায় অপরাধ করেছেন। আইনের লঙ্ঘনকারীদরে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। পুলিশের ধারণা, বড় ধরনের ক্ষতিসাধনের লক্ষ্যে এসব জ্যামার বসানো হয়েছিল। এদিকে রাজধানীর এয়ারপোর্ট রোডের লা মেরিডিয়ান হোটেল থেকে কাওলা ওভারব্রিজ পর্যন্ত সড়কে চলাচলের সময় হুটহাট চলে যায় মোবাইল নেটওয়ার্ক। বন্ধ হয়ে যায় ডাটা ট্রান্সফার। এলাকাটি বিভিন্ন অপারেটরের মোবাইল টাওয়ারের তরঙ্গসীমার মধ্যে থাকলেও নেটওয়ার্ক বিঘিœত হওয়ার কারণ মেলেনি। তবে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নেটওয়ার্ক না পাওয়া, কল ড্রপসহ গ্রাহকের বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহে নেমে চোখ কপালে উঠেছে মোবাইল অপারেটরদের। জরিপে দেখা গেছে, সারা দেশে অহরহ ব্যবহার হচ্ছে অবৈধ জ্যামার, নেটওয়ার্ক বুস্টার ও রিপিটার। অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস অব বাংলাদেশ (অ্যামটব) সারা দেশের ৩২৫টি স্থান চিহ্নিত করে যেখানে এ ধরনের অবৈধ ডিভাইসের কারণে মোবাইল নেটওয়ার্ক বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ঢাকাতেই এ রকম স্থান পাওয়া যায় ২১২টি। অপারেটরদের পৃথক হিসাবে ঢাকায় এক হাজারের বেশি স্থানে এসব অবৈধ প্রযুক্তির কারণে নেটওয়ার্ক বিঘিœত হচ্ছে। জরিপে দেখা গেছে, ব্যক্তি পর্যায়ে, বিভিন্ন ধর্মীয় উপাসনালয়, অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে ব্যবহার হচ্ছে জ্যামার। অনেকে আবার ভালো নেটওয়ার্ক পেতে নিজ বাড়িতে বুস্টার বা রিপিটার বসিয়েছে। এতেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ওই এলাকার অন্যান্যদের নেটওয়ার্ক। গত ১৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর তেজগাঁও ও বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে জ্যামার, বুস্টার ও রিপিটার বিক্রির অপরাধে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। বিটিআরসির নিষেধাজ্ঞা ও অভিযানের মধ্যেও প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে এসব জ্যামার, বুস্টার ও রিপিটার। গতকাল এ রিপোর্ট লেখার সময়ও বিডিস্টল.কম, ক্লিকবিডি.কম সহ বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটে প্রকাশে জ্যামার, বুস্টার বা রিপিটার বিক্রি করতে দেখা গেছে। কিছু পোর্টেবল জ্যামার বিক্রি করতে দেখা গেছে, যা গাড়িতেও চার্জ দেওয়া যায়। একবার চার্জ দিলে ২০-৩০ মিটারের মধ্যে সব মোবাইল নেটওয়ার্ক দুই-তিন ঘণ্টা বন্ধ রাখতে পারে। গ্রামীণফোনের চিফ করপোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) হোসেন সাদাত বলেন, অবৈধ জ্যামার, রিপিটার বা বুস্টার মোবাইল ফোন নেটওয়ার্কে অযথা সমস্যা তৈরি করে যা কল ড্রপ, ইন্টারনেট গতি না পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। অনেক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান না বুঝেই বাংলাদেশে নিষিদ্ধ এসব প্রযুুক্তি অবৈধভাবে ব্যবহার করছে, যা গ্রাহকের ভোগান্তির বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, গ্রাহকের স্বার্থে অবৈধভাবে আমদানিকৃত এসব প্রযুক্তি ব্যবহার বন্ধে আইন প্রয়োগকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
এদিকে সমস্যা সমাধানে ২০১৮ সালের নভেম্বরে ও ২০২০ সালের অক্টোবরে বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় অ্যামটব। এর পর বিভিন্ন মার্কেটে অভিযান চালিয়ে অনেককে আটক করা হয়। এসব যন্ত্রপাতি কেনাবেচা ও ব্যবহার না করতে বিটিআরসি থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। তবুও বেড়েছে এগুলোর ব্যবহার। এ ব্যাপারে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেন, সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে। বিটিআরসির অনুমোদন ছাড়া স্থাপিত এ ধরনের অবৈধ যন্ত্রপাতি অপসারণের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।