আজকে যে শাইখ সিরাজকে আপনারা চেনেন, জানেন, সপ্তাহ শেষে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানটি মনোযোগ দিয়ে দেখেন, সেই শাইখ সিরাজ প্রথম থেকেই কী শাইখ সিরাজ ছিল? পৃথিবীর অনেক দেশে এখন আমার থেকেও মানুষ শাইখ সিরাজকে নিয়ে বেশি জানতে চায়। তাকে নিয়ে হাজারটা প্রশ্ন করে। অনেকেই বলেন, আপনি কতো সৌভাগ্যবান শাইখ সিরাজের সঙ্গে কাজ করছেন। আমাদের তরুণ সমাজ যারা টেলিভিশন অনুষ্ঠান তৈরি করতে চায়, বিশেষ করে ডকুমেন্টারি তৈরি করতে চায় তাদের অবশ্যই শাইখ সিরাজের কাজগুলো দেখা উচিত। তার সঙ্গে নিয়মিত ক্লাস করা উচিত। আমাদের দেশে যে যন্ত্রপাতি আছে, আমাদের দেশে যে সুবিধা আছে তা দিয়ে কীভাবে ডকুমেন্টারি, প্রামাণ্য অনুষ্ঠান তৈরি করা যায়।শাইখ সিরাজ কি টেলিভিশনের মধ্যেই মানুষ হয়েছে? মোটেই না। শাইখ সিরাজ আপনার, আমার মতো। দশটা সাধারণ মানুষের মতোই বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। শাইখ সিরাজের বাসায় ছোট বেলায় কোনো চলচ্চিত্র বা শিল্প সাহিত্য বিষয়ক পত্রিকা যেতো না, কোনো টেলিভিশনও ছিল না। কিন্তু তার টান ছিল পত্রিকার প্রতি, টান ছিল টেলিভিশন আর বেতারের প্রতি।দীর্ঘদিন একটি বিখ্যাত সাপ্তাহিকে কাজ করেছে। যার বাসায় টেলিভিশন নেই সেই শাইখ সিরাজ দীর্ঘদিন কাজ করেছে বাংলাদেশ টেলিভিশনে, বেতারে।
আমাদের অনেকেরই যাত্রা শুরু টেলিভিশনে ছোটদের অনুষ্ঠান করে। শাইখ সিরাজের প্রথম দিককার উপস্থাপনা ছিল একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে। সুধীমালা নামের সেই অনুষ্ঠানের প্রযোজনায় ছিলেন আল মনসুর। অনুষ্ঠানে শাইখ সিরাজের উপস্থাপনায় প্রথম গান গেয়েছিলেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাসহ অনেক নামিদামি শিল্পী। এর আগে শাইখ সিরাজ টেলিভিশনে খেলাধুলার প্রচুর অনুষ্ঠান করেছে। কাজের সূত্রে খাবার দাবারের দোকানে আমি ও শাইখ সিরাজ দীর্ঘ সময় কাটাতাম। তখন বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামকে কেন্দ্র করে বেশির ভাগ খেলাধুলা হতো। শাইখ সিরাজের কৃষি নিয়ে কোনো প্রাথমিক পড়াশুনাও ছিল না। কিন্তু খেলাধুলা নিয়ে অনেক উৎসাহ ছিল। বিশেষ করে ফুটবল। স্টেডিয়ামে কোনো গুরুত্বপূর্ণ খেলা হলে শাইখ সিরাজ স্কুল- কলেজ বাদ দিয়ে খেলা দেখতে চলে যেতো। খেলা দেখার সময় গেটে থাকতো প্রচণ্ড ভিড়। গেটের টিকিট কাটতে লাগতো বেশি টাকা। তার বদলে এই স্টেডিয়ামে দড়ি বেয়ে উঠে যেত। এতে কম টাকা লাগতো, ভিড়ও থাকতো না। শাইখ সিরাজ বহু ফুটবল খেলা দেখেছে দড়ি বেয়ে উঠে। ফুটবলের প্রতি তার ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা।
একবার জীবিকার তাগিদে আমি, শাইখ সিরাজ ও আরেকজন বন্ধু একটি চাইনিজ খাবারের দোকান দিয়েছিলাম। খুব যে দোকানটা চলতো তা নয়, তবে আমাদের সহায়তা করতে অনেক বন্ধুবান্ধব প্রায়ই সে দোকানে আসতো। যাবার সময় তারা বলতো তোদের রেস্টুরেন্টের রান্না ভালো না, আর আসা যাবে না। তখন শাইখ সিরাজ বলতো, আমি নিজে কিচেনে গিয়ে রান্না করে দিলাম। আর তুই বলছিস রান্না ভালো হয়নি। এখানেই শাইখ সিরাজের সরলতা। শাইখ সিরাজকে কে বোঝাবে যে রান্না করতে হবে প্রপার শেফে। কিন্তু শাইখ সিরাজ কিচেনে গিয়ে রান্না করেছে। এই রান্নাতো ভালো হওয়ার কথা নয়। সে চেয়েছে রান্নার সঙ্গে একটু মায়া মেশাতে। যেন রান্নাটা আরও সুস্বাদু হয়। এই কাজটা শাইখ সিরাজ সব সময়ই করেছে।
‘শিল্পায়নে বাংলাদেশ’ বলে একটা অনুষ্ঠান হতো। সেই অনুষ্ঠানের উপস্থাপক ছিল শাইখ সিরাজ। সেই অনুষ্ঠানে অনেক জায়গায় যেতে হতো। বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিতে গিয়ে শিল্প নিয়ে, শিল্পের প্রসার নিয়ে কথা বলতো। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রামাণ্য অনুষ্ঠানের প্রথম হাতেখড়ি তার। এরপর এলো ‘মাটি ও মানুষ’। এখন পর্যন্ত ৫/৬ জন পেয়েছি যারা বলেছেন তারা ‘মাটি ও মানুষ’ শুরু করেছেন। তাদের পরিকল্পনা ছিল, তারা শুরু করেছেন। শাইখ সিরাজ পরে এসে যুক্ত হয়েছে। কথাটা সত্য-মিথ্যা দুটোই হতে পারে। হয়তো তারা একসঙ্গে শুরু করেছেন। এটা হতেই পারে। শাইখ সিরাজও তখন থেকেই যুক্ত। প্রারম্ভিক সময়ে যারা ছিলেন শাইখ সিরাজ তাদের একজন। কিন্তু ‘মাটি ও মানুষ’ মানেই শাইখ সিরাজ। শাইখ সিরাজ এই অনুষ্ঠানটিকে এতটাই জনপ্রিয় করেছেন যে, টেলিভিশনের ইতিহাসে সেই সময়ে একমাত্র ঈদের আনন্দমেলা ছাড়া কিংবা ছায়াছবির গান ছাড়া আর কোনো অনুষ্ঠান এত জনপ্রিয় হয়নি।
কৃষিভিত্তিক একটি অনুষ্ঠান দেখবে কৃষকরা। গানের অনুষ্ঠান দেখবে শিল্পীরা। শাইখ সিরাজ বললেন, তাহলে সিনেমায় বিষ খাওয়ার দৃশ্যে বিষ খেতে হবে শিল্পীদের। সুতরাং কৃষি অনুষ্ঠান মোটেই কৃষকদের জন্য শুধু নয়। কৃষি অনুষ্ঠান হবে কৃষকদের নিয়ে যারা পলিসি তৈরি করেন তাদের জন্য। পুরো অনুষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল। সিরাজ মাঠের কৃষকের সঙ্গে মাটিতে বসে পান্তা ভাত খেতে খেতে প্রশ্ন করলো। ঠিক তেমনি কৃষি বিভাগের বড় কর্তা বা কৃষিমন্ত্রীর সঙ্গে বসেও টক্কর দিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলো। রাতারাতি একটি অনুষ্ঠান টেলিভিশনের অফপিক থেকে চলে গেল পিক আওয়ারে। কৃষি নিয়ে এই অনুষ্ঠান করতে করতে শুরু হলো কৃষিনির্ভর ফিলার। মৎস্য খামার, ছোট স্থানে চাষ এসব বিষয় দেখানো শুরু হলো। এ সময় একদিন মোস্তফা কামাল সৈয়দ, সেই সময়ের বিটিভির জেনারেল ম্যানেজার বললেন, এই অংশটুকু একটু কেটে বের করে দেন আমরা মাঝে মাঝে টেলিভিশনে ফিলার হিসেবে দেখাবো। টেলিভিশনের পর্দার চেহারা পাল্টে গেল।
সিরাজ ভোরবেলা শুটিংয়ে বের হতো। একদিন দেখলাম অনেক ভোরবেলা সিরাজ দাঁড়িয়ে আছে টেলিভিশনের একটি কামরার সামনে। এখানে তুমি কী করো, তোমার তো আউটডোরে যাবার কথা? সিরাজ বলল, একটা কাজের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। কি কাজ? আজকে অনেক কষ্টে আমাদের স্টেশনের চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে আমি রাজি করিয়েছি- তিনি বলেছেন যে, তিনি জিনিসটা আমাকে দেবেন। কয়েকদিন আগে আমি দেখেছি একটা মাইক্রোফোন এসেছে যেটাতে কোনো তার লাগে না। কডলেস মাইক্রোফোনের কথা বলছে। এটা দিয়ে কথা বলার সময় কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এটা তো বড় অনুষ্ঠান ছাড়া দিতে চায় না। আউটডোরে তো আরও দিতে চায় না, আমাকে দেবেন বলেছেন। বলেছেন, আপনি নিজের হাতে নেবেন, নিজের হাতে ফেরত দেবেন। এখনো আসে নাই, অপেক্ষা করছি। এক ঘণ্টা পর ভদ্রলোক এলেন। এসে বললেন, তুমি এখনো দাঁড়িয়ে আছো। তোমার ইউনিট তো বেরিয়ে যাবার কথা। সিরাজ বলল, আমি মাইক্রোফোন ছাড়া কি করে যাবো? এর মধ্যে কিন্তু অন্য সদস্যরা সিরাজকে কয়েকবার তাড়া দিয়ে গেছে। চলেন চলেন, দেরি হচ্ছে। ভদ্রলোক মাইক্রোফোন দিলেন। বললেন, অনেক দামি, সতর্কভাবে ব্যবহার করবেন। দেখলাম, সিরাজ তার ছাড়া মাইক্রোফোন দিয়ে ছোট ছোট জিনিসগুলোকে কীভাবে ব্যবহার করে শটের মাধুর্য এনেছেন তা গোটা বিশ্বের বাঙালি দর্শকদের জন্যই শিক্ষণীয়।
মাটি ও মানুষের বাইরে চ্যানেল আইতে শাইখ সিরাজ অনেক কিছু করেছেন। সিনেমার গান, পুরনো দিনের গান। আমি বলি সাজানো প্রোগ্রাম। সিরাজ যদি মনোযোগ দিয়ে একটা সোফা এদিক থেকে ওদিকে নেন, একটা গাছ এদিক থেকে ওদিকে নেন তাহলে দৃশ্যপট পুরো পাল্টে যায়। দেখা যায় ক্যামেরায় যে শটটা আসছে তা আরও মনোমুগ্ধকর হয়ে গেছে। সিরাজ ডকুমেন্টারি অসাধারণ করেন। আরেকটি বিরাট ব্যাপার কৃষকের ঈদ আনন্দ। আমরা যখন ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে আধুনিক প্রযুক্তি খুঁজি, আধুনিকতার কথা শুনি তখন সিরাজ কৃষকদের জন্য শুরু করলেন ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’। এই অনুষ্ঠান করতে এই বয়সে তাকে যে পরিশ্রম করতে হয় যেকোনো সাধারণ মানুষ দেখলেও তা বুঝতে পারবেন। শুধু করে আসা নয়, দীর্ঘ সময় ধরে অনুষ্ঠানের মান সিরাজ ধরে রেখেছে। ঈদের আনন্দমেলায় প্রতিবছর উপস্থাপক পরিবর্তন হয়। কিন্তু একজনই কৃষকের বন্ধু, একজনই উপস্থাপক। একজন ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড় অনেক প্রোডাক্টের মডেল হন। সিনেমা স্টার অনেক প্রোডাক্টের মডেল হন। শাইখ সিরাজ আজ পর্যন্ত কৃষিকে পুঁজি করে কোনো প্রোডাক্টের মডেল হয়নি। কৃষিকে পুঁজি করে সিরাজ কোনো টাকা রোজগার করেনি। যতটুকু পেরেছে ততটুকু দিয়ে কৃষিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।
অনেক মানুষ আছেন যারা এখন মধ্য বয়স্ক। যারা যুবক বয়সে শাইখ সিরাজের মাটি ও মানুষ দেখে উৎসাহিত হয়েছেন। পড়াশুনার বাইরে আমি কৃষি কাজ করবো, যেটা আমাকে সম্পদ দেবে, সম্মান দেবে। সারা দেশে এমন অনেক মানুষ পাবেন যারা শাইখ সিরাজের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছেন। এই অনুষ্ঠান যে শুধুই একটা অনুষ্ঠান বলা যাবে না, এটা এখন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হওয়ার জন্য তার পরিবারের ভূমিকাও কম নয়। বিয়ের পর ছোট একটা বাসা নিয়ে থাকতো। বাসার অর্ধেক ভরে থাকতো চিঠি দিয়ে। বস্তার পর বস্তা চিঠি আসতো। কোনো কোনো সপ্তাহে ১০ বস্তা চিঠি আসতো। রিকশায় করে, ভ্যানে করে আমরা সেই চিঠি বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতাম। সিরাজ প্রতিটা চিঠি পড়তো। যতটা সম্ভব জবাব দিতো। ভাবি হাসিমুখে মেনে নিতো। তাদের অনেকেই স্মৃতি রোমন্থন করার জন্য চ্যানেল আইতে আসেন। সিরাজকে নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করতে গেলে অনেক কথা বলা যাবে, অনেক ভাবা যাবে।
জীবনে যে মানুষটার বাসায় একটা টেলিভিশন ছিল না সেই মানুষ গোটা বিশ্বের বাঙালির কাছে আজ মস্ত বড় এক মানুষ। এই মানুষটি একটি অনুষ্ঠানের পেছনে যে পরিশ্রম করেন, ভোরবেলা মাঠে চলে যাওয়া, গ্রীষ্ম ও শীত একই রকম কাপড় পরে অনুষ্ঠান করে যাচ্ছে। আমার মনে হয় তার অনুষ্ঠানের একটি ফ্রেমও সে নিজে না দেখে ছাড়েনি।
আমাদের মা-বোনরা যখন রান্না করেন তখন তারা প্রথম স্বাদটা দেখেন ঠিক আছে কিনা। মায়া মমতা মা- বোনের রান্নায় থাকবেই। যে অনুষ্ঠানটি সিরাজ আপনাদের হাতে তুলে দেয় এটার প্রথম স্বাদ সে নিজে নেয়। এ কারণে শাইখ সিরাজ যে অনুষ্ঠানই করুক না কেন আপনারা বলেন, আহা আরেকটি দারুণ অনুষ্ঠান করলো। দেশের প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, আমি কৃষি নিয়ে, বাংলাদেশের অনেক কিছু নিয়ে শাইখ সিরাজের অনুষ্ঠান দেখে পরামর্শ গ্রহণ করি এবং বোঝার চেষ্টা করি বাংলাদেশের কতোটুকু উন্নতি এই কাজটা করলে হবে। আবার খুব সাধারণ কৃষক মাটির ঘর থেকে বলেন, আহারে শাইখ সিরাজের কথা শুনে যদি ক্ষেতের এই ওষুধটা না দিতাম তাহলে এত সুন্দর ফসল হতো না। বাংলাদেশের ক’টা মানুষের ভাগ্যে এমনটি জোটে। এই ভালোবাসা শুধু শাইখ সিরাজের প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য শাইখ সিরাজের কাজের। শাইখ সিরাজ দীর্ঘজীবী হোক।
সুত্রঃ মানবজমিন