রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। অথচ সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। গবেষণায় উঠে এসেছে কঠিন বর্জ্য থেকে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কারণে রাজধানীর নিম্ন আয়ের ৩৪ ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যগত জটিল অবস্থার শিকার হচ্ছে। এর মধে ২৭ ভাগ মানুষ ময়লা পানির কারণে, ১৯ শতাংশ মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে স্বাস্থ্যগত নানা জটিলতার শিকার হচ্ছে। এদের অধিকাংশ বস্তিবাসী।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা মহানগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেয়া জরুরি। সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে মহানগর দূষণে আক্রান্ত হবে। পরিবেশ রক্ষায় সচেতন না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য ঢাকা রেখে যাওয়া সম্ভব হবে না। বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে মোট ১২৯টি ওয়ার্ড রয়েছে। প্রতিদিন এই শহরে ৬ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন বর্জ্য সৃষ্টি হয়। দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব ট্রান্সফার স্টেশন ও ডাস্টবিন থেকে নিয়মিত বর্জ্য অপসারণ করা। এরপর সেগুলো চূড়ান্ত ডিসপোজাল সাইটে নিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ডিসপোজ করা। অথচ টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না।
সম্প্রতি ইউনিসেফের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীর কঠিন বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার ফলে মারত্মক পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে ঢাকায় বসবাস করা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁঁকির মধ্যে পড়ছে। জ্বর, সর্দি, মাথাব্যথা, চর্মরোগ, ইউরিন ইনফেকশন, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, কোনো ক্ষেত্রে ক্যান্সার, জন্ডিস, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড রোগের মতো বিপজ্জনক রোগের বিষয়টিও গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এ ধরনের রোগ সাধারণত অবিশুদ্ধ ও অনিরাপদ পানি খাওয়া, অনেকক্ষণ ময়লার মধ্যে থাকার কারণে হয়ে থাকে।
এতে বলা হয়, ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। পর্যাপ্ত উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতার কারণে তার প্রায় ৩৫ শতাংশই অপসারণ করা হচ্ছে না। এগুলোর শেষ ঠিকানা হচ্ছে নগরের আশপাশের রাস্তা, খাল, বিল, জলাধার, নিম্নাঞ্চলে। এসব কঠিন বর্জ্য সঠিক সময়ে নিষ্কাশন না করা বা পুর্নব্যবহারের উদ্যোগ না থাকায় নগরের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলছে। বর্জ্যরে এই অব্যবস্থাপনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে নগরের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। যাদের আবাস নগরের বস্তি এলাকাগুলোতে।
‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যগত প্রভাব’ শীর্ষক ইউনিসেফের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে ১৯৭১ সালে জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ লাখ। ২০২২ সালে এসে তা প্রায় সোয়া ২ কোটিতে পৌঁছেছে। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা অনুযায়ী ঢাকার ৫ হাজারেরও বেশি বস্তিতে প্রায় ৪০ লাখেরও বেশি লোক বসবাস করে। এসব বস্তিবাসীর জন্য এখন পর্যন্ত অন্তর্ভুক্তিমূলক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। ফলে দীর্ঘমেয়াদে তারা শারীরিক, মানসিক, আর্থিক ও সামাজিকভাবে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। নগরবাসীর জনস্বাস্থ্যকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
রিপোর্টে আরো বলা হয়েছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারিভাবে উদ্যোগের ঘাটতি রয়েছে। এসব এলাকায় বর্জ্যরে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধাগুলো রিপোর্টে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের তদারকি ও জবাবদিহিতার অভাব। উচ্চ সেবা মূল্য, পরিবেশ ধ্বংস ও দূষণের তদারকির অভাব, অপরিকল্পিত ও অপ্রতুল পয়ঃব্যবস্থা, ড্রেন ও পানি নিষ্কাশনের অভাব, সরাসরি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (এসটিএস) ব্যবহার করতে না পারা। এসটিএসের অব্যবস্থাপনা, অধিবাসীদের সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রমের অভাব। সিটি করপোরেশন থেকেও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তির ব্যবস্থাও নেয়া হয়।
এর ফলে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শারীরিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁঁকি তৈরি করছে। এর মধ্যে রয়েছে জন্মের সময় প্রতিবন্ধকতা ও প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁঁকি। এছাড়াও ক্রনিক ডিসঅর্ডার, ইনফেকশনস তৈরি করছে। তাদের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁঁকিও বাড়াচ্ছে। যেমন-মেজাজ খিটখিটে থাকা, অকারণে রেগে যাওয়া, মানসিক চাপ, হতাশা ও আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া, মনঃসংযোগহীনতা ও মানসিক অস্থিরতায় প্রভাব ফেলছে। সামাজিক ও আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আর্থিকভাবে নগরবাসীর চিকিৎসা ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আয় হ্রাস পাচ্ছে বলে গবেষণায় দেখা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ রাখা উচিত। কঠিন বর্জ্য অব্যবস্থাপনার ফলে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে। যা জলবায়ু পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখছে। বর্জ্যে অব্যবস্থাপনা চক্রের মাধ্যমে খাদ্যপ্রণালি হয়ে শরীরেও ঢুকে যাচ্ছে। অসংক্রামক ব্যাধি সেই চক্রের মাধ্যমে সংক্রামক ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে একটি রাষ্ট্রের মোট জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ জনস্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত। অথচ সেখানে আমাদের রয়েছে শূন্য দশমিক ১ শতাংশেরও কম।