রাজধানীর উত্তরায় ময়মনসিংহগামী চলন্ত একটি বাস থেকে ছোঁ মেরে এক ব্যক্তির মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। ওই ব্যক্তি কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিমেষেই লাপাত্তা হয়ে যায় ছিনতাইকারী। বুধবার রাত ৯টার দিকে উত্তরার জসীম উদ্দীন এলাকায় শৌখিন পরিবহনে এ ঘটনা ঘটে। এভাবে রাজধানীতে ক্রমেই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছিনতাইকারী চক্র। সশস্ত্র ছিনতাইকারী চক্র ছিনতাই কাজে ব্যবহার করছে মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও মোটরসাইকেল। এদের টার্গেট ভ্যানেটিব্যাগ, হাতব্যাগ, স্বর্ণালঙ্কার ও মোবাইল ফোনসেট। রাজধানীতে রয়েছে শতাধিক ছিনতাই স্পট। প্রায় ৬০০ ছিনতাইকারী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পুরো রাজধানী।
এদের কেউ অজ্ঞান পার্টি, কেউ মলম পার্টি, কেউ আবার সালাম পার্টির সদস্য। শুধু রাতে নয়, দিনের বেলায়ও সর্বস্ব লুটে নিয়ে মুহূর্তে সটকে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা আতঙ্কিত করে তুলেছে নগরবাসীকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে আরও তৎপর হতে হবে পুলিশ-র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।
রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে শুরু করে অলি-গলিতে বেপরোয়া ছিনতাই বাড়ছে। এই ছিনতাইকারীদের হাতে যখন-তখন প্রাণ হারাচ্ছে নিরীহ মানুষ। অনেকে আবার আহত হয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে করুণ পরিণতি। ছিনতাইকারীর হাতে প্রাণ হারানো বা নির্মম ঘটনার শিকার এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। এর বাইরেও অহরহ ছিনতাইয়ের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। এমনকি ছিনতাইয়ের কবল থেকে মন্ত্রী কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও রক্ষা পাচ্ছে না। প্রতিদিন গড়ে ২৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
গত ২৭ মার্চ মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় দন্ত চিকিৎসক আহমেদ মাহি বুলবুল ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন। এ ঘটনায় বুলবুলের স্ত্রী শাম্মী আক্তার মিরপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। পরে গরিবের চিকিৎসকখ্যাত বুলবুলের হত্যাকারীদের ধরতে অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই ঘটনায় ৩০ মার্চ রায়হান ওরফে আপন, রাসেল হোসেন হাওলাদার, আরিয়ান ওরফে হাফিজুল ও সোলাইমান নামে চার ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়। ডিবি বলছে, মোবাইল ফোনসহ অন্য সব কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার সময় বাধা দেওয়ায় ডা. বুলবুলকে খুন করে মোবাইল ফোন নিয়ে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা। ২২ মার্চ মাহমুদ হোসাইন নামে এক ব্যক্তি শাহবাগ থেকে রিকশায় সেগুনবাগিচা যাচ্ছিলেন। তিনি রমনা পার্কের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন ছিনতাইকারী মোটরসাইকেলে এসে তার কাছে থাকা মূল্যবান সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়। ১৭ মার্চ সাংবাদিক কামাল হোসেন তালুকদার গুলিস্তান থেকে আজিমপুর বাসায় যাওয়ার পথে ছিনতাইয়ের কবলে পড়েন। ছিনতাইকারীরা তার সঙ্গে থাকা ব্যাগ ও মোবাইল ফোন নিতে সজোরে ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দেন। এতে সাংবাদিক কামাল মারাত্মক আহত হন। শুধু তারা দুজন নয় সাম্প্রতিক সময়ে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে প্রায়ই নগদ টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান সামগ্রী হারাতে হচ্ছে। রাত গভীর হলে যানবাহন ও মানুষের সমাগম কমে গেলে ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে পড়ে। তখন বেশকিছু এলাকায় রিকশা ও পায়ে হেঁটে চলাচলকারীদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশীয় অস্ত্রধারী ও দলবদ্ধ এসব ছিনতাইকারীর সঙ্গে যুদ্ধ করাও কঠিন। একটু বল প্রয়োগ করতে গেলে প্রাণে মেরে ফেলার ভয় থাকে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা গেছে, ডিএমপির ৬টি বিভাগের তালিকা অনুযায়ী উত্তরা বিভাগে ৫২ জন, মিরপুর বিভাগে ৫৬ জন, গুলশান বিভাগে ৯৭ জন, রমনা বিভাগের ১১৬ জন, তেজগাঁও বিভাগের ১২২ জন ও ওয়ারী বিভাগে প্রায় দেড় শতাধিক ছিনতাইকারী সক্রিয় রয়েছে। এদের বেশিরভাগই মাদকসেবী। ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, অর্থনীতি কর্মকান্ড সীমিত হয়ে যাওয়ায় ছিনতাইকারীদের তৎপরতা বেড়েছে। ছিনতাইয়ে সক্রিয় পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির তালিকা তৈরি করা হয়েছে। মাদক ও ছিনতাইয়ের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স। যে কোনো মূল্যে ছিনতাই প্রতিরোধ করা হবে।
রাজধানীর অলি-গলি, প্রধান সড়কসহ বিভিন্ন স্পটে দিনে বা সন্ধ্যায় মোটরসাইকেলে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। রাতে বা ভোরে ছিনতাইকারীরা বের হয় প্রাইভেটকার নিয়ে। মোটরসাইকেল বা প্রাইভেটকারে নারীদের ভ্যানিটি ব্যাগ, রিকশাযাত্রীদের মোবাইল ফোন সেট, মানিব্যাগ ছিনতাই করছে। এমনকি যাত্রী বা পথচারীদের পথরোধ করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে জিম্মি করছে। কেড়ে নিচ্ছে নগদ অর্থ, মোবাইল ফোনসহ গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম। ভয় দেখিয়ে এটিএম কার্ড দিয়ে টাকা তুলছে। গুলি করে বা কুপিয়ে আহত করে, এমনকি হত্যা করেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ছিনতাইয়ের অনেক ঘটনাই থানা-পুলিশের কাছে যায় না। চুরি ও ছিনতাইয়ের শিকার বেশির ভাগ মানুষই হয়রানি ও ঝামেলার আশঙ্কায় মামলা করেন না। এতে করে চুরি ও ছিনতাইয়ের মামলা হয় কম। মামলা হলেও চুরি ও ছিনতাই করা টাকা উদ্ধার করতে পারে না পুলিশ। আবার কেউ কেউ মামলা করতে গেলেও থানা তা নেয় জিডি হিসেবে। এতে করে প্রকৃত ঘটনা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিরা বলছেন, পুলিশ জানে কোন কোন এলাকা ছিনতাইপ্রবণ। এরপরও ব্যবস্থা নিতে তাদের অনীহা। ঘটনা জানালেও প্রভাবশালী না হলে প্রতিকার পাওয়া যায় না। নানান ভোগান্তি সইতে হয়। পুলিশ বলছে, ছিনতাইয়ের ঘটনা জানালে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এ ছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ট্রিপল নাইনে (৯৯৯) কল করেও এ সেবা পাওয়া যাচ্ছে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রাজধানীতে বিভিন্ন ছিনতাই স্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্যাট্রল ডিউটি বৃদ্ধি করা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ স্পটে চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়েছে। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। ছিনতাইকারীদের প্রতিরোধে র্যাব প্রতিনিয়ত সোচ্চার রয়েছে।