দেশের প্রায় সর্বত্র ভেজাল ও নকল ওষুধের ছড়াছড়ি। অসাধু ব্যবসায়ীরা ‘অজ্ঞাত’ স্থানে নকল ওষুধ উৎপাদন করে ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আবার অনেক ফার্মেসি মালিক নামমাত্র মূল্যে নকল-ভেজাল ওষুধ কিনে রোগীর হাতে তুলে দিচ্ছেন। অথচ এ ব্যাপারে নেই ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের দৃশ্যমান তৎপরতা। ফলে ভেজাল-নকল ওষুধের লাগাম টানা সম্ভব হচ্ছে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নকল-ভেজাল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণনে রাজধানীসহ সারাদেশে ৪০টি চক্র সক্রিয়। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হয়। কিন্তু জামিনে বেরিয়ে আবার শুরু করে ভেজাল ওষুধ তৈরির কাজ। গত কয়েক বছরে পুরনো ঢাকার মিটফোর্ডের মার্কেট থেকেই শতাধিক কোটি টাকার ভেজাল ওষুধ জব্দ করা হয়েছে। নকল ওষুধ তৈরির সাথে জড়িত চক্রের পাইকারি বাজার মিটফোর্ড। এখান থেকেই ভেজাল ওষুধ সারাদেশে ছড়ায়। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অনেক ফার্মেসি মালিক কম টাকায় ওষুধ কিনতে মিটফোর্ড আসেন।
সর্বশেষ গ্রেফতার হওয়া নকল ওষুধ উৎপাদনকারী চক্রটির মূল হোতা ফয়সাল। সে ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে আয়ুবের্দিক ওষুধ তৈরির একটি লাইসেন্স নিয়েছিল। সেটি ব্যবহার করে পিরোজপুরের বিসিক শিল্পনগরীতে কারখানা স্থাপন করে। আতিয়ার নামে এক কেমিস্টের কাছ থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ওষুধের ফর্মুলাও নিয়ে শুরু করে নকল ওষুধ উৎপাদন। মিটফোর্ডের মুহিব নামে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে রাসায়নিক সংগ্রহ করতো ফয়সাল।
সেগুলো সাভার ও পিরোজপুর পাঠিয়ে নকল ওষুধ তৈরি করে আবার নিয়ে আসতো মিটফোর্ডে। মিটফোর্ড থেকেই ফয়সালের সহযোগী মোবারক, নাসির, ওহিদুল, মামুন, রবিন, ইব্রাহীম, আবু নাইম ও আরেক ফয়সালের মাধ্যমে সারাদেশে বিক্রি করতো লাভের আশায়। ফার্মেসি মালিকরা রাজি হলে কুরিয়ারের মাধ্যমে ওষুধ পাঠানো হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে মিটফোর্ড, কুমিল্লার কাপ্তান বাজারের হিমালয় ল্যাবরেটরিজ এবং সাভারসহ বিভিন্ন জায়গায় পরিচালত অভিযানে ৩৫ লাখ পিস নকল ওষুধ জব্দ করা হয়। এসব নকল ওষুধের অধিকাংশই আবার অ্যান্টিবায়োটিক। এটি অ্যান্টিবায়োটিক সেবনকারীদের জন্য এক ভয়ঙ্কর বার্তা। তিনি বলেন, করোনার চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে নকল অ্যান্টিবায়োটিক। ভেজাল ওষুধ উদ্ধারের পাশাপাশি এর সাথে জড়িত ৪৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
অতিরিক্ত কমিশনার আরো বলেন, ওমিপ্রাজল গ্রুপের গ্যাসের ওষুধ দেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এটি নকল হওয়ায় খুবই খারাপ বার্তা দিচ্ছে। পুলিশ প্রায়ই ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। ভেজাল ও নকল ওষুধের লাগাম টানতে এবং নজরদারির ক্ষেত্রে জনসাধারণ, কোম্পানিসহ সবারই উচিত সচেতন হওয়া। এক প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, যে ওষুধগুলো জব্দ করা হয়েছে তার অধিকাংশই দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের। কপিরাইট আইনে মামলা হলে পুলিশের জন্য তদন্ত ও জালিয়াত চক্রকে ধরা খুবই সহজ হবে।
বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি কাজী মফিজুল ইসলাম কামাল ইনকিলাবকে বলেন, ভেজাল ও নকল ওষুধ দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য মারাত্মক হুমকি। একাধিক চক্র ভেজাল ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে। প্রতিটি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করে এ ধরণের অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের একজন চিকিৎসক বলেন, নকল ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন ভয়াবহ অপরাধ। দৃষ্টান্তমূলক সাজা না হলে এটি থামবে না। এতে রোগ তো সারেই না, উল্টো আরও জটিলতা বাড়ে। নকল ওষুধের কারণে ব্যক্তির শারীরিক ক্ষতির সঙ্গে আর্থিক ক্ষতিও হয়।
গত ১২ মে ডিএমপির গোয়েন্দা পুলিশের কোতয়ালি জোনাল টিম রাজধানী, সাভার ও পিরোজপুরের নেছারাবাদ বিসিক শিল্প এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ নকল ওষুধ জব্দ করে। এসময় গ্রেফতার করা হয় আটজনকে। এরা রীতিমতো কারখানা বানিয়ে নামিদামি ব্র্যান্ডের মোড়কে নকল ওষুধ বানাতো। কারখানা থেকে নকল ওষুধ তৈরির যন্ত্রপাতি উদ্ধার করা হয়েছে।
গত ৬ জুন ডিবির একটি দল ঢাকার মিটফোর্ড, কুমিল্লার কাপ্তান বাজারের হিমালয় ল্যাবরেটরিজ এবং সাভারে প্রতিষ্ঠানটির গোডাউনে অভিযান চালিয়ে প্রায় ২২ লাখ পিস নকল ওষুধ জব্দ করে। এ সময় ভেজাল ওষুধ তৈরি, বিপণন, মজুতের সঙ্গে জড়িত ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো- হিমালয় ল্যাবরেটরিজের মালিক মোর্শেদ আলম শাওন, সাভার গোডাউনের কবির হোসেন, কুমিল্লায় নকল ওষুধের ডিস্ট্রিবিউটর আল আমিন চঞ্চল, নকল ওষুধ প্যাকেজিংয়ে জড়িত মো. নাজিম উদ্দিন, গোডাউন রক্ষণাবেক্ষণকারী মো. তৌহিদ। এছাড়া গোডাউন ও ওষুধ তৈরি কারখানার অপারেটর ও শ্রমিক আইনুল ইসলাম, মো. সাগর, মো. আবির, মো. রুবেল, মো. পারভেজ।
জব্দ ওষুধ হচ্ছে- ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্যানটোনিক্স-২০ এমজি নয় লাখ ১৮ হাজার ৪৫৬ পিস, স্কয়ারের সেকলো-২০; চার লাখ ১০ হাজার ৪০০ পিস, দ্য একমি ল্যাবরেটরিজের মোনাস-১০; ৫৮ হাজার ৫০ পিস, হেল্থকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সার্জেল ক্যাপসুল ৯৬ হাজার পিস, অপসোনিন ফার্মার ফিনিক্স-২০; ৫৮ হাজার ৮০০ পিস, কুমুদিনি ফার্মার অ্যান্টিবায়োটিক দিজা ছয় হাজার ২৪০ পিস, আমবে ফার্মাসিউটিক্যালসের গুুরফ-৫০০; ছয় হাজার ৪৮০ পিস, জেনিথের ন্যাপ্রোসিন প্লাস ৪১ হাজার ৪০০ পিস, ব্রোনসন-ইউএসএ-এর জিবি-৬০; তিন হাজার পিস।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ফার্মেসি মালিকরাও মাত্রাতিরিক্ত মুনাফার লোভে বিক্রি করতো এসব নকল ওষুধ। ইটের গুঁড়ার সঙ্গে নানা ধরনের রঙ ও কেমিক্যাল মিশিয়েও ওষুধ বানানো হয়। গ্রামগঞ্জে এসব ওষুধই নাকি বেশি বিক্রি হয়। কারণ নকল ওষুধে বিক্রেতাদের লাভ অনেক বেশি। শুধু মুখে খাওয়ার ওষুধই নয়Ñ ইনহেলার, অয়েন্টমেন্ট বা ইনজেকশনের মতো ওষুধও নকল হচ্ছে। এমন উপাদান দিয়ে ইনহেলার তৈরি হয়েছে, এতে উপকার তো নয়ই; বরং মারাত্মক ক্ষতি করে।