জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব হিসেবে বাংলাদেশে বেড়ে গিয়েছে সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। কিন্তু পোল্ট্রি সামগ্রীর দাম বাড়া নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে বিস্তর আলোচনা চলছে। বিশেষ করে মুরগির গোশত ও ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাজারের ব্যয় সামলাতে কাটছাঁট করতে হচ্ছে মধ্য ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে। গত দুই সপ্তাহের ব্যবধানে রাজধানীতে ফার্মের মুরগির ডিমের দাম ডজনে ৪০ টাকা বেড়ে ১৬০ টাকায় উঠেছে। আর পোল্ট্রি মরুগির দাম ৪০ তেকে ৬০ টাকা বেড়ে ২০০ থেকে ২২০ টাকায় পৌঁছেছে। এর আগে কখনই ডিমের দাম এতটা বাড়তে দেখা যায়নি। এখনও ডিমের হালি ৫০ টাকার বেশি। প্রায় প্রতিদিনই বেড়ে যাওয়া দাম নিয়ন্ত্রণে এবার ডিম আমদানির চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। এ সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন ভোক্তারা। পাশাপাশি দেশে এভাবে হুট করে পণ্যটির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার জন্য পোল্ট্রি খামারি, মধ্যসত্ত্বভোগী ও ব্যবসায়ীদের দায়ী করেছেন তারা। এই সিন্ডিকেটের কারণে কোন কারণ ছাড়াই ডিমের বাজারে উত্তাপ বেড়েছে বলে মনে করছেন ক্রেতারা।
এদিকে এক মাস ধরে ডিমের দাম এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে যাওয়ার পর তীব্র জন-অসন্তোষ ও অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে। খামারিরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে মুরগির বাচ্চার দাম না পাওয়ায় দেশে এখন মুরগি ও ডিমের উৎপাদন সঙ্কটে পড়েছে। মুরগি ‘কমেছে বলে’ এমনটি হয়েছে। পাশাপাশি জ্বালানির দাম বাড়ায় তিন দিন ট্রান্সপোর্ট বন্ধ ছিল যার প্রভাব পড়েছিল বাজারে। এছাড়া এই শিল্পের প্রায় ৭০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। মুরগির খাদ্য, পরিবহন ব্যয় ও ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় সবমিলিয়ে মুরগি ও ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। একইসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে মুরগির বাচ্চার দাম না পাওয়ায় দেশে এখন মুরগি ও ডিমের উৎপাদন সঙ্কটে পড়েছে। এ প্রসঙ্গে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী মন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আমরা কৃষি মন্ত্রণালয়, মৎস্য মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটা মন্ত্রণালয় ডিমের ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করে কীভাবে কমানো যায়, সেই চেষ্টা করছি। তবে সব কিছু কিন্তু রাতারাতি করা সম্ভব নয়।
ডিম নিয়ে এক প্রশ্নে বাণিজ্যমন্ত্রী মনে করেন, সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা বেশি মুনাফা করছে। তিনি বলেন, সুযোগ যখন নেয় সবাই একবারে লাভ দিয়ে করে নেয়। রাতারাতি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা কৃষি, মৎস্যসহ কয়েকটি মন্ত্রণালয় মিলে ডিমের ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করব, দাম কীভাবে কমানো যায়। আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ডিম আমদানি করতে তো একটু সময় লাগবে। আমরা দেখি, যদি এমনটাই হয় যে সত্যি ডিম আমদানি করলে এটা কমবে, তাহলে আমরা ডিম আমদানির প্রক্রিয়ায় যাব।
সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে, ফার্মের মুরগির ডিমের হালি এখন ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। যা ৬০ টাকার বেশিও উঠেছিল। এক সপ্তাহ আগেও যা ছিল ৪৩ থেকে ৪৭ টাকা। এক মাস আগে ছিল ৩৮ থেকে ৪০ টাকা হালি। আর এক বছর আগে ছিল ৩৩ থেকে ৩৫ টাকা। অর্থাৎ এক সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ২০ শতাংশের মতো, এক মাসে বেড়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ আর এক বছরে বেড়েছে ৫৪ শতাংশের বেশি। ডিমের এই দাম বৃদ্ধির বিষয়টি খতিয়ে দেখতেই বৈঠকে বসার কথাও জানান টিপু মুনশি। তিনি বলেন, সেখানে আলোচনা হয় কেন ডিমের দাম এমন হলো। তৃণমূলে কোনো সমস্যা হচ্ছে কি না, আমরা সেগুলো দেখছি। বিভিন্ন সময় এমন অসুবিধা হয়েছে, সেগুলো আমরা অ্যাড্রেস করেছি। দু-চার বা পাঁচ দিন সময় অবশ্য লেগেছে।
সেগুনবাগিচা কাঁচা বাজারের ডিমের পাইকার ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, প্রায় সময় আমার সহকারী সেলিম তেজগাঁও থেকে ডিম নিয়ে আসে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরে ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমি নিজে যাচ্ছি। আমি আড়তদারের কাছে হঠাৎ করে ডিমের দাম বাড়ার কারণ জানতে চেয়েছিলাম। তারা আমাকে জানিয়েছেন, বেশ কয়েক মাস ধরে মুরগির খাদ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ডিমের দাম বাড়ছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়ে পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় ডিমের দাম আরও বাড়াতে হয়েছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, সবকিছুর দাম বেড়েছে। পোল্ট্রি মুরগির খাদ্যসহ ৭০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। গত কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে মুরগির খাদ্য তৈরির সামগ্রী যেমনÑ ভুট্টা ও সয়ামিলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ভুট্টার ৫০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। গত বছর ভুট্টা ১৭ টাকা কেজিতে ক্রয় করা হয়েছে। এ বছর ৩৪/৩৫ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। সয়ামিল শতভাগ আমদানি নির্ভর। গত বছর সয়ামিল ৩৪/৩৫ টাকা ছিল। যা এখন ৬০/৬২ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে।
একইসঙ্গে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি খরচ আরও বেড়ে গেছে। ডিম সারা দেশে উৎপাদন হয়। খামারিদের কাছ থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে পাঠানো হয়। একইভাবে পোল্ট্রির খাদ্যও সারাদেশের খামারিদের কাছে পৌঁছাতে হয়। জ্বালানির দাম বাড়ায় ট্রান্সপোর্ট খরচও বেড়েছে। এসব কারণে মুরগির খাদ্য উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে।
পোল্ট্রির খাদ্যের দাম বৃদ্ধির পর লোকসান হওয়ার কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে দাবি করে মশিউর রহমান বলেন, অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করেও ন্যায্য মূল্যে বাচ্চা বিক্রি করতে না পেরে ব্যাপকভাবে লোকসান হয়েছে হ্যাচারির। যেমন একটা মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ পড়ে ৩০ টাকা। কিন্তু বিক্রি করতে না পেরে ৫/৬ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। আবার অনেক সময় ফ্রিতেও দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন এভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে অনেক হ্যাচারি বন্ধ হয়ে গেছে। আর হ্যাচারি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মুরগির উৎপাদন কমে গেছে। যেমন দুই মাস আগে যেখানে সপ্তাহে প্রায় ২ কোটি ১৭ লাখ বাচ্চার উৎপাদন ছিল, সেখানে বর্তমানে উৎপাদন নেমে এসেছে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখে।
বাজারের চাহিদার তুলনায় মুরগির বাচ্চা উৎপাদন কমে যাওয়ায় মুরগি ও ডিমের দাম বেড়ে গেছে বলে দাবি করেন তিনি।
বিপিআইসিসি সভাপতি বলেন, কয়েকদিন বেশিই বেড়েছিল ডিমের দাম। বিশেষ করে গত ৭, ৮ ও ৯ আগস্ট জ্বালানির দাম বাড়ায় ট্রান্সপোর্ট বন্ধ ছিল। যার প্রভাব পড়েছিল বাজারে। এখন কিছুটা কমে এসছে দাম। তবে সবকিছুর দাম বাড়ায় ডিমের দাম খুব বেশি কমবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।