বিদেশে পাচার হওয়া কালো টাকা দেশে ফিরে আনতে সুশীল সমাজ, বিশিষ্টজনদের বাধা না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, বিদেশে পাচার করা টাকায় দেশের গরিবের হক রয়েছে। গরিব হওয়ার কষ্ট আমি বুঝি। নিজে গরিব ছিলাম। আমি জানি এ থেকে মুক্তি পেতে হলে সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, টাকার ধর্ম হলো যেখানে সুখ বেশি, সেখানে চলে যায়। এ জন্য আমরা ধারণা করছি, টাকা পাচার হয়েছে। এ জন্য ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত অনেকেই জেলে আছেন। এই টাকা মানুষের হক। এতে বাধা দেবেন না। টাকা ফেরত না এলে আপনাদের (সাংবাদিকদের) লাভ কী। বিশ্বের ১৭টি দেশ এভাবে টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
বিদেশে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ দেশে ফেরত আসবে আশাবাদী অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, আমরা পাচার হয়ে যাওয়া টাকা দেশে ফেরত আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করব। একই সঙ্গে যারা টাকা বিদেশে পাচার করেছেন, তাদের জন্য দেশে টাকা ফিরিয়ে আনা এখনই মোক্ষম সময়। কারণ, পাচার হওয়া অর্থ দেশে আনলে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। পৃথিবীর অনেক দেশই বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের সুযোগ দিয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ ১৪টি দেশ এ ধরনের সুযোগ দিয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ২০১৬ সালে এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে এনেছিল। সার্বিক বিষয় চিন্তা করে আমরা এই সুযোগ দিয়েছি। একই সঙ্গে সব টাকা কালো টাকা না। কিছু টাকা বিভিন্ন কারণে কালো টাকা হয়ে যায়। কালো টাকা না বলে আমরা অপ্রদর্শিত টাকা বলছি। সেই টাকাগুলোর জন্যই আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। এই অর্থবছরে অনেক চড়াই-উৎরাই আসবে। তবে এবারের বাজেট বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতি আগের তুলনায় অনেক শক্তিশালী হবে।
গতকাল রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সমালোচনা করে বলেছে, পাচার হওয়া টাকা দেশে আনার উদ্যোগ অনৈতিক। এই টাকা কেউ দেশে ফেরত আনবে না এ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এসব কথা বলেন। মহামারি করোনার কারণে প্রথা ভেঙে ২০২০-২১ অর্থবছরের ভার্চুয়ালি বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর ২০২১-২২ অর্থবছরে সীমিত পরিসরের পাশাপাশি ভার্চুয়ালি বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন করা হয়। অর্থাৎ, তিন বছর পর গতকাল স্বাভাবিক নিয়মে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলন হয়।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী হিসেবে আ হ ম মুস্তফা কামালের এটি চতুর্থ বাজেট। আর বাংলাদেশের জন্য ৫১তম। পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ২০তম বাজেট হলেও ২০০৮ সাল থেকে বর্তমান সরকার টানা বাজেট দিয়ে যাচ্ছে।
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনা হবে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ভারতের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা পি কে হালদার ও তার অর্থ-দুটোই ফেরত দিতে চেয়েছে। তিনি বলেন, অর্থপাচার করে পি কে হালদার ভালো অবস্থায় নেই। যে টাকা নিয়ে গেছেন, ইন্ডিয়ান গভর্নমেন্ট বলেছে ফেরত দেবে। হালদার কেও বের করে দেবে। তাকে দেশে আনা হবে। কানাডাও বলেছে, যারা টাকা নিয়ে গেছে তাদের বাড়ি-ঘর কেনা বন্ধ। এখন সেখানে টাকা নিয়ে যাওয়াও বন্ধ। তাই আমি মনে করি, যারা টাকা নিয়ে গেছে তাদের এখন মোক্ষম সময় দেশে টাকা ফিরিয়ে আনার। অনেকে না জেনেও টাকা নিয়ে গেছেÑ জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এখন সেই টাকা সাদা করে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে কাজ করা হচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি এ সুযোগ সবাই নেবে। একই সঙ্গে আমরা বাজেটে বলে দিয়েছি, এটা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। এর আগে রেমিট্যান্সেও প্রণোদনা দিয়ে বলেছিলাম, কোনো প্রশ্ন করা হবে না। আমরা প্রশ্ন করিনি। আগামীতেও প্রশ্ন করা হবে না বলে উল্লেখ করেন অর্থমন্ত্রী।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা নিয়ে বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করবেন, বাড়ি-ঘর করবেন, আর কেউ প্রশ্ন করবে নাÑ এটা তো হবে না! এটা ঠিক নয়। অর্থমন্ত্রী বলেন, এক সময় আপনাকে ঠিকই প্রশ্ন করা হবে। তাই একমাত্র পথ সরকারের আইন ও বিধিনিষেধ মেনে সরকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা। আমি মনে করি, যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কাজ হবে। দেশে টাকা ফিরে আসবে।
তিনি বলেন, যে ঘুস দেয়, যে নেয়-দুজনেই জাহান্নামে যাবে। আমরা দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করার চেষ্টা করি। এটা নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়। মালয়েশিয়াও এটি করেছে। সব দেশই করে, আমরা কেন করব না। টাকা কিন্তু আসবে, কেন আসবে না।
যারা টাকা ফেরত আনবেন, তারা সুরক্ষা পাবেন কি-না, এ প্রশ্ন করা হলে তার উত্তর দেয়ার দায়িত্ব পড়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের ওপর। তিনি বলেন, এবার যারা টাকা ফেরত আনবেন, তারা সংসদের মাধ্যমে আইন দ্বারা সুরক্ষিত হবেন। ফলে তাদের সুরক্ষা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। আগের ট্রুথ কমিশন কোনো আইনে স্বীকৃত ছিল না। এ প্রসঙ্গে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, তখন দেশে সাংবিধানিক সরকার ছিল না। এখন ধারাবাহিক সাংবিধানিক সরকার আছে। ফলে যারা টাকা ফেরত আনবেন, তাদের কোনো সমস্যা হবে না।
বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার অস্থির হলেও তা থাকবে না বলে আশা ব্যক্ত করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা ডিমান্ড বলতে বুঝিয়েছি, যে পরিমাণ ডিমান্ড দেখালে বাজেট বাস্তবায়ন হয়। আমরা ভালো করে ফেলতে পারলে বাস্তবায়ন করা হয়। বাজারে যে অস্থিরতা আছে সারাবিশ্বে কোথায় দাম বাড়ছে আপনারা জানেন। গত এক বছরে ব্যবহৃত পণ্যের দাম ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এটির কিছুটা প্রভাব আমাদের এখানে পড়বেই। দেশীয় প্রোডাক্ট আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সেটা আমরা নিয়নন্ত্রণে রাখছি। বাইরে থেকে আসা পণ্য নিয়ন্ত্রণে রাখা তো সম্ভব নয়। তবে বাজারে অস্থিরতা থাকবে না। সেটি নিয়ন্ত্রণে সরকার চেষ্টা করছে।
অনেকে এই বাজেটকে গরিব মারার বাজেট বলছে, আপনি এই বাজেটকে এককথায় কী বলবেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, গরিব হওয়ার যন্ত্রণা আমি বুঝি। এবারের বাজেট ছাড়া আমি গত তিন বছরে তিনটা বাজেট দিয়েছি। এবারের বাজেটসহ গত তিনবারের কোনো বাজেটই গরিব মারার ছিল না। আমরা সবসময় দেশের জনগণের কথা চিন্তা করে বাজেট দেই। প্রত্যেকটা গরিব মানুষকে সামনে রেখেই বাজেট করি। সুতরাং, এটা নিয়ে আপনাদের দুশ্চিন্তা করার কারণ নেই। আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, বর্তমানে আমাদের অনেক পণ্যের দাম একটু বেশি, এটা সত্য। তবে এটা হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। এর ফলে সারাবিশ্বেই নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এখানে কারো হাত নেই।
মন্ত্রী বলেন, এবার আমরা যে বাজেট প্রণয়ন করেছি, সেটি আমার মনে হয় দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাজেট। সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যই এবারের বাজেট দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন হলে দেশের অর্থনীতি আগের তুলনায় অনেক শক্তিশালী হবে। তবে একটা বিষয় মনে রাখবেন, যখনই কোনো চ্যালেঞ্জ আসে, চ্যালেঞ্জ শুধু একা আসে না, সুযোগও নিয়ে আসে। যেমন- আমাদের রফতানি আয় বেড়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের কোনো দেশের ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় নেই। কিন্তু আমরা করছি। সেজন্যই বলি, চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সুযোগ তৈরি হয়।
আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, দেশীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করার জন্যই ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন প্রভৃতি আমদানির ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বাজেট থেকেই একটি বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছি। সেটা হলো ‘মেড ইন বাংলাদেশ’। যদি দেশের ভেতরে কোয়ালিটি সম্পন্ন পণ্য উৎপাদিত হয়, তাহলে বিদেশ থেকে আনাটাকে আমরা ভালো দেখি না। বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি করে আনাকে আমরা নিরুৎসাহিত করি। আমরা চাই ‘মেড ইন বাংলাদেশে’র পণ্যের চাহিদা বাড়ুক’। মন্ত্রী বলেন, বাজেটে জনগণের প্রত্যাশা ও সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করা হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বাজেটে প্রতিটি খাতে আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট বাস্তবায়ন অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী ও প্রাণবন্ত করবে।
অর্থসচিব আব্দুর রউফ বলেন, উৎপাদন বাড়ালে মানুষ বেশি খাবে। ডিমান্ড কমানোর কথা বলা হয়েছে। বাজেটের সাইজ কিন্তু কমানো হয়েছে, এর মাধ্যমে ডিমান্ড কমানো হয়েছে। ১ জুলাইয়ের পর কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কিছু প্রকল্প আছে যেগুলোতে অল্প কিছু মানুষ বেনিফিট পায়, সেগুলো আমরা কমাবো। সরকারের প্রধান বাজেট ঠিক থাকবে।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনি, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তফা জব্বার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, অর্থ সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, বাংলাদেশের মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) মুসলিম চৌধুরী, এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হোনা মো. রহমাতুল মুনিম, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা।
উল্লেখ্য, জাতীয় সংসদে গত বৃহস্পতিবার আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য পৌনে ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় সাড়ে ৭ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬ শতাংশে আটকে রাখার লক্ষ্য নেয়া হয়েছে। দেশকে করোনা মহামারিপূর্ব উন্নয়নের ধারায় ফিরিয়ে আনতে নতুন বাজেটে বেশকিছু প্রস্তাব করেছেন মন্ত্রী। এর মধ্যে থাকছে বিনিয়োগ বাড়াতে পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ দেশে আনার সুযোগ এবং করপোরেট করে ছাড়।
বাজেট প্রস্তাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে আয়কর অধ্যাদেশে নতুন বিধান যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। সে অনুযায়ী বিদেশে অবস্থিত কোনো সম্পদের ওপর কর পরিশোধ করা হলে আয়কর কর্তৃপক্ষসহ সরকারের কেউ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন তুলবে না। বিদেশে অর্জিত স্থাবর সম্পত্তি দেশে না আনলে এর ওপর ১৫ শতাংশ, অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং নগদ অর্থের ওপর ৭ শতাংশ কর বসানোর সুপারিশ করেছেন অর্থমন্ত্রী।