শান্তি প্রতিষ্ঠাকে একটি মহৎ কাজ অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের জাতীয় পতাকার মান সমুন্নত রেখে বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী শান্তি প্রতিষ্ঠাকারি দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা কোন যুদ্ধ বা সংঘাত চাই না, শান্তি চাই। সারাবিশে^ শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক সেটাই আমাদের কাম্য। বিশ্ববাসীর পাশাপাশি বাংলাদেশের জনগণ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আপনাদের এই ভূমিকা চিরকাল স¥রণ রাখবে। গতকাল রোববার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস-২০২২’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠানে যোগদান করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বছরের শান্তিরক্ষী দিবসের থিম ‘জনগণের শান্তি অগ্রগতি: অংশীদারিত্বের শক্তি’-এর মাধ্যমে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় আরও কার্যকর ভূমিকা পালন করার অঙ্গীকার করেন।
অন্যদিকে আইএসপিআরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও রোববার যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস উদ্যাপিত হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী বিশে¡র সকল দেশের শান্তিরক্ষীদের অসামান্য অবদানকে এই দিনে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স¥রণ করা হয়। দিবসটি উপলক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধান, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও), পুলিশের মহাপরিদর্শক, জাতিসংঘের মহাসচিব এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
শান্তিরক্ষী দিবসের কর্মসূচির অংশ হিসেবে গতকাল বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে শহীদ শান্তিরক্ষীদের নিকট-আত্মীয় এবং আহত শান্তিরক্ষীদের সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সংবর্ধনায় ভিটিসির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের কার্যক্রম শুরুর পর শান্তিরক্ষা কার্যক্রমকালীন শাহাদাতবরণকারীদের জন্য এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ওপর বিশেষ উপস্থাপনার আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বক্তব্য রাখেন। এছাড়া জ্যেষ্ঠতম শান্তিরক্ষী হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ এবং জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের সামরিক উপদেষ্টা বক্তব্য প্রদান করেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী।
বিশে^র বিভিন্ন স্থানে কর্মরত শান্তিরক্ষীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পেশাদারিত্ব ও সততা বজায় রেখে নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব স্ব-স্ব পালন করতে হবে। নিজেদের সুরক্ষিত রেখে আত্মবিশ^াস নিয়ে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জল করতে কাজ করবেন। কারণ, বিশ্ব শান্তি প্রচার করা একটি মহৎ কাজ। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর তরুণ সদস্য ২১ শতকের বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জাতিসংঘের আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রয়োজনে আরো শান্তিরক্ষী পাঠাতে প্রস্তুত। বিশ^ করোনাভাইরাসের মত মহামারী অতিক্রম করতে করতেই আবার একটি যুদ্ধের দামামা (রাশিয়া-ইউক্রেন) বেজে উঠেছে। যা আজকে বিশ^ অর্থনীতির ওপর বিরাট প্রভাব ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠান থেকে ভার্চ্যুয়ালি সংযুক্ত দক্ষিণ সুদান, লেবানন, সেন্ট্রাল আফ্রিকা রিপাবলিক এবং কঙ্গোতে অবস্থানকারি বাংলাদেশী কন্টিনজেন্টের সঙ্গে মত বিনিময় করেন। তিনি ইউ এন পিস কিপিং জার্নালের একটি ভলিউমের মোড়কও উন্মোচন করেন। আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক, সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের সামরিক উপদেষ্টা জেনারেল বিরামে ডিওপ এবং বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি জিওন লুইস অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শান্তিরক্ষা মিশনে দুই শহিদের পরিবারকে এবং সাহসিকতার জন্য একজনকেসহ ১৪ জন আহত শান্তিরক্ষীকে পদক প্রদান করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার মহৎ উদ্দেশ্যে জীবন উৎসর্গকারী শান্তিরক্ষীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ৩৪ বছরের যাত্রার ওপর একটি ছোট ভিডিও ডকুমেন্টারিও প্রদর্শিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কেবল বাঙালি জাতিরই নন তিনি ছিলেন সমগ্র বিশে^র নিপীড়িত নির্যাতিত শোষিত মানুষের মুক্তির ও শান্তির দূত। তাই, তিনি আলজিয়ার্সে এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘বিশ^ আজ দু’ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে। তিনি মানুষকে শোষণ বঞ্চনা থেকে মুক্তি দানের জন্যই নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন এবং স্বাধীন জাতি হিসেবে আমাদের প্রতিষ্ঠা করেন।এজন্য বিশ্ব শান্তি পরিষদ তাঁকে ‘জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার’-এ ভূষিত করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২৫-এ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণে বিশ্বের সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অব্যাহত সমর্থনের বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
তিনি বলেন, জাতির পিতার শান্তি সেনানীরূপে ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় প্রথম শান্তিরক্ষী প্রেরণ করে ‘ব্লু হেলমেট’ পরিবারের সদস্য হয়। আজ আমরা ‘সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ’ হিসেবে গৌরবের ৩৪ বছর উদ্যাপন করছি। আজ সমগ্র বিশ্বে শান্তিরক্ষায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বজনবিদিত এবং এই অবস্থান নিশ্চিতভাবে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, এ মুহূর্তে বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় ১২১টি দেশের ৭৫ হাজার ৫১৬ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের ৬ হাজার ৮২৫ জন শান্তিরক্ষী রয়েছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের ৫১৯ জন নারী শান্তিরক্ষী বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে নিয়োজিত আছেন। তিনি বলেন, আমাদের শান্তিরক্ষীরা ৪৩টি দেশে ৫৫টি মিশন সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছেন। বর্তমানে ১৩টি মিশনে আমাদের শান্তিরক্ষীরা নিয়োজিত রয়েছেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বেশ কিছু উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিভিন্ন মিশনে ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার এবং সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দাযিত্ব পালন করছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাবাব ফাতিমা বর্তমানে জাতিসংঘের পিস-বিল্ডিং কমিশনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।
আইএসপিআরের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস উপলক্ষে রোববার ঢাকার তেজগাঁওস্থ পুরাতন বিমান বন্দর মসজিদ কমপ্লেক্সে এবং অন্যান্য বিভাগীয় শহরে ্রগ্ধশান্তিরক্ষী দৌড়-২০২২›› এর মাধ্যমে দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়। আইনমন্ত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে ্রগ্ধশান্তিরক্ষী দৌড়-২০২২›› উদ্বোধন করেন। শান্তিরক্ষী দৌড়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের শান্তিরক্ষীগণ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা এবং আন্তঃবাহিনী সংস্থাসমূহের মনোনীত প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন।