মীরসরাইতে আনন্দ ভ্রমণে গিয়ে ফেরার পথে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত ১১ জনের বাড়িতে আহাজারি থামছে না। হাটহাজারীর আমানবাজার, খন্দকিয়া, চিকনদন্ডিসহ আশপাশের গ্রামে চলছে শোকের মাতম। শোকের জনপদ এসব গ্রামে স্বজন হারাদের সাথে কাঁদছেন প্রতিবেশিরাও। একই এলাকার ১১ কিশোর-যুবকের এমন চলে যাওয়ায় বিষাদের কালো ছায়া সর্বত্র। গতকাল শনিবার হাজারো শোকার্ত মানুষের অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে তাদের জানাযা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে। লাশের সারি আর সারি সারি কবর- এমন দৃশ্য আগে কখনো দেখেনি হাটহাজারীর মানুষ। এদিকে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার পর গ্রেফতার গেটম্যান সাদ্দাম হোসেনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। সাদ্দামকে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। ঘটনা তদন্তে রেলের পক্ষ থেকে গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি তাদের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে।
গত শুক্রবার দুপুরে মীরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ঝরনাতে বেড়ানো শেষে মাইক্রোবাসে ফেরার পথে বড়তাকিয়া রেলক্রসিংয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখি আন্তঃনগর মহানগর প্রভাতি এক্সপ্রেস ট্রেনের ধাক্কায় এই দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে প্রাণ যায় পর্যটকবাহী মাইক্রোবাসের ১১ যাত্রীর। আহত হয়েছেন আরো ছয়জন। এই ঘটনার পর দায়িত্বে অহবেলার অভিযোগে ওই ক্রসিংয়ে দায়িত্বরত গেটম্যান সাদ্দাম হোসনকে আটক করে রেলওয়ে পুলিশ।
শুক্রবার রাতে জিআরপি থানায় এএসআই জহির বাদী হয়ে অবহেলাজনিত মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে সাদ্দামের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। দুর্ঘটনার পর পর ঘটনাস্থলে প্রত্যক্ষদর্শী এবং মাইক্রোবাসে আহত কয়েকজন জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার সময় বড়তাকিয়া রেলক্রসিংয়ের গেটম্যান অনুপস্থিত ছিলেন এবং গেটে কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। ক্রসিং অরক্ষিত রেখেই গেটম্যান সাদ্দাম জুমার নামাজ পড়তে মসজিদে গিয়েছিলেন।
এদিকে রাতেই নিহতদের লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। চমেক হাসপাতাল থেকে তাদের লাশ নিয়ে যাওয়া হয় হাটহাজারীতে। হতাহত সকলে সেখানকার আর অ্যান্ড জে কোচিং সেন্টারের ছাত্র-শিক্ষক। নিহতদের মধ্যে কয়েকজনের বাড়ি হাটহাজারীর আমানবাজার থেকে দেড় কিলোমিটার পূর্বে খন্দকিয়া গ্রামে। এই গ্রামের মানুষ এখন শোকে স্তব্ধ। মেধাবী তরুণদের এমন মৃত্যু এলাকার লোকজন মেনে নিতে পারছেন না। নিহতদের পরিবারকে সান্তনা দেওয়ার ভাষাও নেই। স্বজনদের সাথে কাঁদছেন গ্রামবাসীও।
গতকাল হাটহাজারীর খন্দকিয়া ছমদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত জানাযায় নামে মানুষের ঢল। স্বজনহারাদের কান্নায় সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারনা হয়। এই মাঠে জানাযা হয় রিদোয়ান, সজীব, মারুফ, হাসান ও নিরুর। এছাড়া নিহত হিসামের জানাজা হয় শিকারপুরের নিজ বাড়িতে। সাগর ও মাহিমের জানাজাও সম্পন্ন হয় পারিবারিকভাবে। এর আগে শুক্রবার রাতে সাজ্জাদ, রাকিব ও জিসানের দাফন সম্পন্ন হয়। জানাযা ও দাফনে এলাকার বাসিন্দা ছাড়াও আশপাশের এলাকা থেকে অনেকে যোগ দেন।
নিহতদের ঘরে ঘরে থামছে না আহাজারি। ১১ তরুণের মৃত্যুতে ১১টি পরিবার এখন দিশেহারা। তাদের মৃত্যুর সাথে এসব পরিবারের স্বপ্নেরও যেন মৃত্যু হয়েছে। পড়ালেখা শেষে তারা প্রতিষ্ঠিত হবে, পরিবারের হাল ধরবে এমন প্রত্যাশা ছিল মা-বাবার। সেই স্বপ্ন নিমিষেই ধুলিসাৎ হয়ে গেল।
খন্দকিয়া গ্রামের যুগীর হাট বাজার পেরিয়ে মাইক্রোবাস চালক গোলাম মোস্তফা নিরুর (২৬) বাড়ি। স্বামীর দাফন হয়েছে, কন্যা রুহি আক্তারকে বুকে জড়িয়ে রেখে কান্না থামছে না স্ত্রী রুপা আক্তারের। পাঁচ বছর আগে বিয়ে হয়েছিল তাদের। পুত্রশোকে কাঁদছেন গোলাম মোস্তফার বাবা মো. ইউসুফ। একই এলাকায় কলেজ শিক্ষার্থী জিয়াউল হকের বাড়িতে বিলাপ করছেন মা শাহনাজ আক্তার। ওই বাড়ির পাশে নিহত ইকবাল হোসেনের নানার বাড়ি। মায়ের সঙ্গে এখানেই কেটেছিল শৈশব-কৈশোর। সে কেএস নজুমিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। সেখানেও ভিড় করছেন শোকাতুর মানুষ।
এর প্রায় এক কিলোমিটার দক্ষিণে নিহত ওয়াহিদুল আলমের বাড়িতেও চলছে শোকের মাতম। তিনি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ থেকে ব্যবস্থাপনায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষকতা করতেন সেই কোচিং সেন্টারে। তার বাবা জানে আলম পুত্রশোকে নির্বাক। খন্দকিয়া গ্রামের আবদুল লতিফ মাস্টারের বাড়িতেও চলছে আহাজারি। ওমরগণি এমইএস কলেজে গণিত দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র জিয়াউল কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। কিছুক্ষণ পর পর নিজের বুক চাপড়াচ্ছেন মা শাহনাজ আক্তার। বলছেন, আমার মাস্টার সজীব কই? তাকে ঘিরে বিলাপ করছেন স্বজনেরা। নিহতদের স্বজনেরা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন। তারা বলছেন, রেলওয়ের ক্রসিং অরক্ষিত থাকায় এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। বেঘোরে এমন মৃত্যুর দায় রেলওয়েকে নিতে হবে।