ঈদের আমেজ এখনো কাটেনি। ঈদ করতে যারা গ্রামে গেছেন তারা এখনো কর্মস্থলে ফিরছেন। এরই মধ্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে। আগামী ১৭ জুলাই ঢাকা সফরে আসছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) ৬ সংসদ সদস্য। ১২ জুলাই বিএনপি মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক জিন লুইস। ১৩ জুলাই বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি। বিএনপির সঙ্গে প্রভাবশালী দুই কূটনীতিকের বৈঠকের পর সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়ার অভিযোগ তোলেন। এমন পরিস্থিতিতে ১৪ জুলাই ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে। হঠাৎ করে রাজনৈতিক অঙ্গনের এই উত্তাপ নিয়ে গণমাধ্যম, ইউটিউব ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে ব্যাপক বিতর্ক চলছে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বিদেশিরা যতই ক্ষমতাধর হোক বাংলাদেশের নির্বাচনে তারা প্রভাব ফেলতে পারবে না। ওবায়দুল কাদের প্রতিদিন মিডিয়ায় কথা বললেও ১৩ জুলাই ও ১৫ জুলাই দলীয় প্যাডে বিবৃতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন হবে। ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তার কোনো ব্যত্যয় ঘটাতে চাইলে আওয়ামী লীগ দেশের জনগণকে নিয়ে দাঁতভাঙা জবাব দেবে’। কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপ, কয়েকজন মন্ত্রীর কথাবার্তার ধরন, নির্বাচন কমিশনের ফের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে অসময়ে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।
সংবিধান অনুযায়ী আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রায় দেড় বছর বাকি। ফেব্রুয়ারি মাসে দায়িত্ব গ্রহণের পর নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন পেশাজীবী ও নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে। কিন্তু বিএনপিসহ ১১টি নিবন্ধিত দল সংলাপে অংশ নেননি। যারা অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগসহ মাত্র ৪টি রাজনৈতিক দল ইভিএমে নির্বাচনের পক্ষে মতামত দিলেও অন্য সব দলই ইভিএমের বিপক্ষে মতামত দিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ইসি আবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের আয়োজনের তারিখ চূড়ান্ত করেছেন। এর আগে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি, মার্কিন রাষ্ট্রদূত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতসহ প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা নির্বাচন কমিশনে গিয়ে সিইসি হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে বৈঠক করেন। তারা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচন যেন অবাধ নিরপেক্ষ হয় এবং সব ভোটার যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস জানিয়েছেন জো বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানের প্রত্যাশা করছে।
এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৬ সংসদ সদস্য ঢাকায় আসছেন আগামীকাল রোববার। ঢাকা সফরকালে তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন, শ্রমিকদের শ্রম অধিকার, বাণিজ্য প্রভৃতি ইস্যু নিয়ে আলোচনা করবেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৭ থেকে ২০ জুলাই পর্যন্ত ইইউ প্রতিনিধিদল ঢাকায় অবস্থান করবেন। সফরকালে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানার পরিবেশ ও শ্রমমান পর্যবেক্ষণ করবেন। তবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ইইউ’র সদস্যদের সফরটি মূলত একটি বাণিজ্য বিষয়ক সফর। তাদের সফরকালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, সামাজিক উন্নতি, নির্বাচন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণের মতো বিষয়গুলো আলোচনায় আসতে পারে। অন্যদিকে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি জানিয়েছেন, ইইউ’র আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিটির প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বাংলাদেশ সফর করবেন। বাংলাদেশ ও ইইউ’র মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বাড়াতে তারা আলোচনায় অংশ নেবেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৬ সংসদ সদস্য ঢাকা সফরের আগে গত ১৩ জুলাই ঢাকায় কর্মরত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেন। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দেড় ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক শ্যামা ওবায়েদ। বৈঠকে আগামী নির্বাচন ইস্যুতে কি ধরনের আলোচনা হয়েছে সে সম্পর্কে দু’পক্ষের কেউ মুখ খোলেননি। এর আগের দিন ১২ জুলাই ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক জিন লুইস বিএনপির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টা বৈঠক করেছেন। বৈঠকে আলোচনার ব্যাপারে দুই পক্ষের কেউই গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি। তবে একটি সূত্রের দাবি, আগামী নির্বাচন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা, ঈদ শুভেচ্ছাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হয়েছে।
এদিকে ১৪ জুলাই স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলামের সাথে সাক্ষাৎ করেন নবনিযুক্ত ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াটলি। সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বাইরের কারোর কথা বলার কথা না। অন্য কোনো দেশের নির্বাচন নিয়ে যেমন আমার মন্তব্য করা দায়িত্ব নয়। আমরা হয়তো কোনো কোনো ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। বিশ্বের অনেক দেশেই নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে উল্লেখ করে তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশেও নির্বাচন বিতর্কের ঊর্ধ্বে না। যেসব দেশ অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্যদের হস্তক্ষেপ করার সুযোগ করে দিচ্ছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মূলত ঢাকায় কর্মরত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক জিন লুইস ও ইইউ রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির সঙ্গে বিএনপির রুদ্ধদার বৈঠকের পর সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী বিএনপির বিরুদ্ধে বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়ার অভিযোগ তোলেন। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তথ্য ও সম্প্রদার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বিএনপিকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, বিদেশিদের কাছে দৌড়ঝাঁপ না করে দেশের জনগণের কাছে যান। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, আমাদের দেশের সমস্যা নিজেরাই আলোচনা করে সুরাহা করতে পারি। এ জন্য বিদেশিদের কাছে ধরনা দেয়া কেন?
এমন পরিস্থিতিতে গতকাল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, জনগণ দ্বারা বারবার প্রত্যাখ্যাত হয়ে বিএনপি একটি পতিত রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, বিএনপি নেতাদের আন্দোলনের ডাকে জনগণ কখনোই সাড়া দেয়নি, তারপরও বিএনপি নেতৃবৃন্দ দিবা স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। তারা জনকল্যাণকর রাজনীতির পথ পরিহার করে সব সময় ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করে আসছে। বিএনপি কখনই জনগণকে ক্ষমতার উৎস মনে করে না, বরং তারা রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থে জনগণকে বিভ্রান্ত করার মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘বর্তমানে দেশে ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার কায়েম করা হয়েছে’ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন বিবৃতির জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, এদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন ও রাজনীতির প্রতিভূই হচ্ছে বিএনপি। হত্যা-ক্যু-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবৈধ ও অসাংবিধানিক রাষ্ট্রক্ষমতা দখলকারী স্বৈরাচার জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই এ দেশে ফ্যাসিবাদের যাত্রা শুরু হয়।
এদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিদিন সভা-সমাবেশে অংশ নেন। তারপর তিনি গতকাল এক বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, বিএনপির কর্মসূচির কথা শুনলেই আওয়ামী লীগ বিচলিত হয়ে পড়ে। ‘সরকারের পায়ের নিচের মাটি কাঁপতে শুরু করেছে’ দাবি করে তিনি বলেন, গণতন্ত্রকে উচ্ছেদ করে অবৈধ ক্ষমতা ধরে রাখতে এ সরকার নানা ধরনের সর্বনাশা সহিংস পন্থা অবলম্বন করছে। এমনকি পবিত্র ঈদের আগে-পরেও আওয়ামী সন্ত্রাসের বাড়বাড়ন্ত স্তিমিত হয়নি। পুলিশ এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে, তারা বিএনপির উদ্যোগে ধর্মীয় অনুষ্ঠানকেও বানচাল করতে সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে। এতে সরকারের নৃশংস ফ্যাসিবাদের উগ্র রূপ প্রকাশ পাচ্ছে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নূরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, আফগানিস্তান থেকে বিদায় নেয়ার পর বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ভাবতে শুরু করে। চীনকে মোকাবিলার জন্য ভারতকে কাজে লাগাতে বাংলাদেশকে দিল্লির চোখে এতদিন দেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ভারতের শাসকরা বাংলাদেশের জনগণের বদলে আওয়ামী লীগকে সাপোর্ট করেছে। ’১৪ সালের নির্বাচনের আগে সুজাতা সিং এবং ’১৮ সালের রাতের নির্বাচনের পর মোদি প্রশাসন যেভাবে আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখতে বিশ্বদরবারে দূতিয়ালি করেছে সেটা তাদের জন্য আত্মঘাতী হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সব অপকর্মের দায় মোদি প্রশাসনের ঘাড়ে গেছে। এখন চীনকে ঠেকানোর স্বার্থে ভারতকে হাতে রাখবে যুক্তরাষ্ট্র; তবে বাংলাদেশকে দেখবে মার্কিনিরা নিজের দৃষ্টিতে। ফলে ভারত আর বাংলাদেশের নির্বাচনে অনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারবে না। বাইডেন প্রশাসনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে গণতন্ত্র। আর যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে জো বাইডেন প্রশাসন বার্তা দিয়েছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। আর মার্কিনিরা নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। নির্বাচনে জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করবে তার প্রথম ধাপ র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা। জনগণকে দূরে রেখে ব্রিজ-ফ্লাইওভার বানানো কোনো উন্নয়ন নয়। ইতোমধ্যেই অর্থমন্ত্রী ডলারের জন্য বিশ্বব্যাংকে আবেদন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাতের পুতুল হলো জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ। ওদের কথা না শুনলে কী অর্থ মিলবে? ওদের (যুক্তরাষ্ট্র-ইইউ) কথা না শুনলে কি হয় আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রীরা সেটা সামনে বুঝতে পারবেন। পাকিস্তান কখনোই ভারতকে পাত্তা দেয় না। আফগানিস্তানে মোড়লি চলে গেছে, নেপাল নেই, যে ভুটান ছিল সেখানেও ভারতের বিরোধিতা হচ্ছে। চীনের সঙ্গে অরুণাচল ও লাদাখ বিরোধ মেটেনি। হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র ভারত কার্যত একঘরে হতে চলেছে। ফলে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের নাক গলানো দূরের কথা নিজের ঘর ঠিক রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।