সাহিদুর রহমান মীর। প্রবাসী বাংলাদেশি। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বুটেক্সে বিএসসি করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৭ সালে করেছেন এমবিএ এরপর চীন থেকে মাস্টার্স ও ফিনল্যান্ড থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। এখন অস্ট্রিয়াতে একটি বৈজ্ঞানিক ল্যাবে (ব্লু-কার্ড ক্যাটাগরিতে) গবেষক হিসেবে কাজ করছেন। বাকি জীবন বিদেশেই কাটিয়ে দেয়ার ইচ্ছা তার। দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দেয়ার ব্যাপারে মীর জানান, বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনেক বেশি। কিন্তু কর্মক্ষেত্র স্বল্প।
তাই মেধা থাকলেও দেশে তা দিয়ে কর্মজীবন গড়া খুবই কঠিন। কিন্তু বিদেশে আয়ের সুযোগ অনেক বেশি। তাই এখানে সুন্দর জীবন গড়া যায়। চিন্তা করতে হয় না।
অস্ট্রিয়ার কর্ম পরিবেশে মীর সন্তুষ্ট। প্রতিবছর তাকে ১৪ বার বেতন দেয়া হয়। বছরে বড় দু’টি মৌসুমি ছুটি থাকে। তখন তাকে অতিরিক্ত দুই মাসের বেতন দেয়া হয়। সপ্তাহে আড়াই দিন ছুটি থাকে। এছাড়া প্রতিদিন ৮ ঘণ্টার বেশি কাজও করতে হয় না তাকে। মীর বলেন, বাংলাদেশের হিসেবে এখানে (অস্ট্রিয়া) চাকরি অনেক সম্মানের। বেতনও অনেক বেশি। কিন্তু দেশে এত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে এই বেতনের চাকরি খুবই কঠিন। এখানে বাচ্চাদের পড়ালেখার সব খরচ দেয়া হয়। গাড়ি ভাড়া পর্যন্ত দেয়া হয়। মীর জানান, এসব দেশে ব্লুকার্ড ক্যাটাগরির চাকরি করতে উচ্চ শিক্ষা প্রয়োজন। দেশ থেকে মাস্টার্স থাকলেও হয় না। কেবল অনেক ‘হাই প্রোফাইল’ থাকলেই সুযোগ পাওয়া যায়। কিন্তু চায়না, কোরিয়া কিংবা জাপানের মতো দেশ থেকে খুবই সহজে এখানে ভালো বেতনে চাকরি হয়।
২০২১ ওপেন ডোর রিপোর্ট অন ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশনাল এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, একক গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ৮ হাজার ৫৯৮ জন বাংলাদেশিকে স্টাডি পারমিট দিয়েছে। এই হার ২০০৯ সালের চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। তবে চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের বৃত্তি পাওয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্বিগুণ হবে বলে জানায় ফরেইন এডমিশন অ্যান্ড ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট কনসালটেশনস্ এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (এফএসিডি-ক্যাব)। ইমিগ্রেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ কানাডা’র (আইআরসিসি) তথ্য বলছে, ২০১৬ সালে কানাডা ৮০০ বাংলাদেশি নাগরিককে স্টাডি পারমিট দেয়, যা বেড়ে ২০১৭ সালে ১ হাজার ৮৫০, ২০১৮ সালে ১ হাজার ৯০০ ও ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১৬৫-তে দাঁড়ায়। অর্থাৎ এই ৪ বছরের মধ্যে কানাডায় লেখাপড়ার জন্য বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আবেদন ২৭০ শতাংশ বেড়েছে। এ সময়ে দেশটিতে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে লেখাপড়ার জন্য বাংলাদেশিদের আবেদন বেড়েছে ৩০০ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের দি ইউনিভার্সিটি অব আলাবামায় জিওগ্রাফি বিষয়ের উপর পিএইচডি করছেন বাংলাদেশের আরেক শিক্ষার্থী হিমেল দে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গবেষণা করার সুযোগ খুব কম। নেই বললেই চলে। আমাদের দেশে ভালো ক্যারিয়ার বলতে বিসিএস ক্যাডার হওয়াকে বোঝানো হয়। কিন্তু বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতিতে প্রতিটা শিক্ষার্থীর ২-৩ বছর সময় লাগে। এতে সবাই সাফল্যও পায় না। তখন আমাদের এই সময়গুলো নষ্ট হয়।
ভালো চাকরি নিয়ে দেশে সাফল্য পাওয়া খুবই সময়সাপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক। তাই শিক্ষার্থীদের বিদেশে গবেষণার জন্য চলে যাওয়া ভালো বিকল্প বলেও মনে করেন হিমেল। বলেন, বিদেশে জীবনযাপনের মান দেশের তুলনায় অনেক ভালো। কাজের ক্ষেত্র অনেক। তাই কাউকে ভবিষ্যত নিয়ে খুব একটা শঙ্কায় থাকতে হয় না। লেখাপড়া শেষ করে ভালো কাজের অনেক সুযোগ রয়েছে।
অ্যামেরিকার ম্যানহ্যাটনে এএসএ কলেজের শিক্ষার্থী মো. রিয়াজুল কায়সারেরও একই মতামত। করোনার কারণে দেশে লেখাপড়া দীর্ঘদিন স্থবির ছিল উল্লেখ করে তিনি জানান, অনলাইনের মাধ্যমে কিছুদিন শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হলেও সেই সুবিধা সবাই পায়নি। কিন্তু বাইরের উন্নত দেশগুলোতে অনলাইনের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবেই লেখাপড়া চলেছে। তিনি বলেন, অ্যামেরিকার লেখাপড়ার মান বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। উন্নত দেশে প্রাক্টিক্যাল শিক্ষাকে জোর দেয়া হয় যেটা বাংলাদেশে খুবই কম। এখানের সার্টিফিকেটের মূল্যও অনেক। লেখাপড়ার পাশাপাশি পার্টটাইম চাকরি করে আমরা নিজেদের পড়ালেখার খরচ নিজেরা চালাতে পারি। দেশে এই সুযোগ একেবারেই কম। এখানে ফ্রি চিকিৎসা সুবিধাও পাওয়া যায়।
রাজধানীর শান্তিনগরে অবস্থিত হাবিবুল্লাহ বাহার ইউনিভার্সিটিতে তৃতীয় বর্ষে লেখাপড়া করছেন রবিন হাসান। কিন্তু এখানের লেখাপড়া শেষ না করেই কানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। এজন্য করছেন আইইএলটিএস এর কোর্স। লেখাপড়া শেষ করে সেখানেই থাকার ইচ্ছাও রয়েছে তার। রবিন বলেন, বিদেশের লেখাপড়ার পদ্ধতি অনেক ভালো। সার্টিফিকেটের দামও বেশি। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। ভালো চাকরি পাওয়া যায়। তাই বিদেশে লেখাপড়া করে সেখানেই থাকার ইচ্ছা আছে। বিদেশে সব ধরনের সুযোগ সুবিধাই বেশি পাওয়া যায়। আর্থিক নিশ্চয়তাও অনেক। ভালো চাকরি করে দেশেও টাকা পাঠানো যায়। কিন্তু দেশের বাজারে তেমন চাকরি খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন যেটা দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যায়।
জানা গেছে, শুধু বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রতি ব্যাচের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশই শিক্ষার্থী বিদেশে চলে যায়। তাদের খুব কমসংখ্যকই দেশে ফিরে আসে। আর ইউনেস্কোর ‘গ্লোবাল ফ্লো অব টারশিয়ারি লেভেল স্টুডেন্টস’-এর প্রতিবেদন বলছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে মোট ৪৪ হাজার ৩৩৮ জন শিক্ষার্থী বিদেশে পড়ালেখার জন্য পাড়ি জমান। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ৮ হাজার ১১২ জন শিক্ষর্থী গমন করেন। এছাড়া মালয়েশিয়াতে ৬ হাজার ৯০৪ জন, অস্ট্রেলিয়াতে ৬ হাজার ১৯১ জন, কানাডায় ৩ হাজার ৭৩৫ জন, জার্মানীতে ২ হাজার ৯২০ জন এবং যুক্তরাজ্যে ২ হাজার ৬৪৫ জন শিক্ষার্থী যান। এদিকে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও লেখাপড়ার জন্য ২ হাজার ২৫৮ জন শিক্ষার্থী পাড়ি জমিয়েছেন। করোনা মহামারির জন্য ২০১৯ সালের পর বিদেশ গমন শিক্ষার্থীর পরিসংখ্যান আর হালনাগাদ করতে পারেনি সংস্থাটি। তবে করোনা মহামারির সময়ে এই সংখ্যা আরও অনেক বাড়তে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে লেখাপড়া শেষ করে অনেকেই মেধা কাজে লাগানোর সুযোগ পান না। কাঙ্ক্ষিত চাকরির দেখাও পান না অনেক শিক্ষার্থী। এজন্য বছরের পর বছর দেশের বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। বিদেশ থেকে ডিগ্রি এনেও দেশের কর্মক্ষেত্রে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারেন না। তাই জীবিকার তাগিদে আবার তারা বিদেশে চলে যান।
দেশে বিশ্বমানের লেখাপড়ার সুযোগ কম। মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশের লেখাপড়া শেষ করে বিদেশে যাবে। উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করবে। এজন্য শিক্ষার্থীদেরও উৎসাহিত করছেন বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি মানবজমিনকে বলেন, উচ্চ শিক্ষার জন্য বহু আগে থেকেই শিক্ষার্থীরা বিদেশে যাচ্ছে। আমরাও শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করি। এগুলো খুবই স্বাভাবিক। দেশের একজন প্রযুক্তিবিদ নাসাতে চাকরি করলে তাকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে বলবো না। সে নাসাতে বসেই যে অবদান রাখবে সেটা শুধু অ্যামেরিকা আর বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীকেই বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সেটাতেই বাংলাদেশ উপকৃত হবে। বাংলাদেশের একজন নাগরিক যদি বিজ্ঞান, গবেষণায় এগিয়ে থাকে অ্যামেরিকায় বসে তাহলে বাংলাদেশই গর্বিত। তবে বাংলাদেশে শিক্ষার মান বাড়ানোর দরকার আছে বলেও মত দেন ঢাবির সাবেক এই ভিসি।
দেশে মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানোর ক্ষেত্রটা সংকুচিত উল্লেখ করে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান মানবজমিনকে বলেন, বিশ্বায়নের এই যুগে মেধাবীরা বিদেশে যেতেই পারে। আমাদের একটা ভৌগলিক দেশ আছে কিন্তু সারা বিশ্বই এখন উন্মুক্ত। তাই শিক্ষার্থীরা যেখানে ভালো মনে করে সেখানে অবশ্যই যাবে। কিন্তু দিনশেষে শিক্ষার্থী তার দেশের কাছে দায়বদ্ধ। কারণ সে এই দেশে জন্মগ্রহণ করেছে, বড় হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ের লেখাপড়া করেছে। আমাদের অনেক ছেলেমেয়ে দেশে ফিরেও আসে, অনেক দক্ষ লোক আসে। কিন্তু তারা কিছুদিন পর আবার হতাশ হয়ে ফিরে যায়।
তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষের মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাজে লাগানোর অনীহা আছে। দেশে সবকিছু এখন আমলাতান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে মেধাবীদের আমরা দেশের কল্যাণে কাজে লাগাতে পারছি না। এটা আমাদের ব্যর্থতা, রাষ্ট্রের ব্যর্থতা, সরকারের ব্যর্থতা। এটা আমাদের সকলের ব্যর্থতা।