কুমিল্লার বুড়িচং সীমান্তে সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকার নাঈমকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বুধবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বুড়িচং উপজেলার সীমান্ত সংলগ্ন রাজাপুর ইউনিয়নে হায়দরাবাদ এলাকায় নাঈমকে হত্যা করা হয়। নাঈম ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার অলুয়া গ্রামের সরকার বাড়ির পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এএসআই মোশাররফ হোসেনের ছেলে। এ ঘটনায় নিহতের মা নাজমা আক্তার বাদী হয়ে ৩ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ৫-৭ জনের বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার রাতে বুড়িচং থানায় মামলা করেন। পুলিশ বৃহস্পতিবার রাতভর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে ৪ জনকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে।
জানা গেছে, বুধবার রাত ১০টার দিকে বুড়িচং উপজেলার হায়দরাবাদ নগর এলাকায় নোম্যান্স ল্যান্ডের ২০৬০-৬ এস সীমানা পিলারের ২-৩ গজ বাংলাদেশ অভ্যন্তরে মাদক ব্যবসায়ীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে গুরুতর আহত হন মহিউদ্দিন সরকার নাঈম (২৮)। হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। নিহত মহিউদ্দিন স্থানীয় কুমিল্লার ডাক পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
নিহতের বন্ধু মহল ও পরিবারের দাবি, সীমান্তে মাদকের বিরুদ্ধে নাঈম পত্রিকা ও তার ব্যক্তিগত ফেসবুকে লেখার পাশাপাশি র্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের তথ্য দিয়ে মাদকের একাধিক চালান ধরিয়ে দিতে সহযোগিতা করেন। এতে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীরা তার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল এবং একবার তাকে মারধরও করে। সে রাজুর ছবি দিয়ে ফেসবুকেও পোস্ট দেয়। এরই জের ধরে মাদক ব্যবসায়ী চক্রের মূল হোতা রাজুর নেতৃত্বে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে জেলা পুুলিশের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় বুড়িচং উপজেলার সীমান্ত এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী রাজু তার দুই সহযোগী মনির ও পলাশকে দিয়ে সাংবাদিক মহিউদ্দিন সরকারকে কৌশলে মোবাইলে সীমান্তের পাশে ডেকে নিয়েই গুলি করে হত্যা করে। ঘটনার পর সাংবাদিকের মরদেহ দেখতে বুড়িচং হাসপাতালে যান জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান ও পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ। এ ঘটনায় পুলিশ বৃহস্পতিবার রাতভর অভিযান চালিয়ে মামলার এজাহারনামীয় ফরহাদ মৃধা প্রকাশে মনির (৩৮), মো. পলাশ মিয়া (৩৪), মামলার এজাহার বহির্ভূত নুরু মিয়া ও সুজন নামের দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার নুরু ও সুজন হত্যাকাণ্ডে ঘাতকদের সহায়তা করেছে। সেখানে মহিউদ্দিনকে গুলি করে হত্যার পর গ্রেপ্তার নুরু ও সুজন ঘাতকদের পালিয়ে যেতে সহায়তা করেন। তবে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঘাতকরা একটি মোটরসাইকেল ফেলে যায়। পরে পুলিশ এ মোটরসাইকেলটি উদ্ধার করে।
কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সোহান সরকার বলেন, বৃহস্পতিবার রাতভর অভিযান চালিয়ে কিলিং মিশনে সরাসরি অংশ নেয়া এবং সহায়তাকারী ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে আদালতে রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে। পরবর্তীতে রিমান্ডের শুনানি হবে। তিনি বলেন, মামলার প্রধান আসামি রাজুকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে অভিযান চালাচ্ছে। বুড়িচং কোর্টের জিআরও নুরজাহান বলেন, ৪ আসামিকে ৭ দিনের রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছে, সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আলাউদ্দিন মাহমুদ তাদের জামিন না মঞ্জুর করে কারাগারে প্রেরণ করেছেন। পরবর্তীতে রিমান্ডের শুনানি হবে।
এদিকে এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে শুক্রবার কুমিল্লা প্রেস ক্লাবের সামনে কুমিল্লা ফটোসাংবাদিক ফোরাম, কুমিল্লা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও বুড়িচং প্রেস ক্লাব মানববন্ধনের আয়োজন করে। পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই পুলিশ এ বিষয়ে কাজ করছে। এরইমধ্যে জড়িতদের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে ও ৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্যদের গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে অভিযান চালাচ্ছে।
উল্লেখ্য, এর আগে মাদক পাচারে বাধা দেয়ায় ২০২০ সালের ৫ই মে জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার ভারত সীমান্তবর্তী মথুরাপুর এলাকায় বিজিবি ফাঁড়ির অদূরে আলমগীর হোসেন নামে এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে চোরাকারবারিরা। ২০১৭ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি জেলার দেবিদ্বার উপজেলার বেগমাবাদ গ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদকে বুড়িচংয়ের রাজাপুর ইউনিয়নের লড়িবাগ সিন্দুরিয়া ব্রিজ এলাকায় ছুরিকাঘাতে হত্যা করে চোরাকারবারিরা। এদিকে গত ৮ই এপ্রিল কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার জোড়কানন ইউনিয়নের লালবাদ এলাকায় র্যাবের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের গুলি বিনিময়ে এক র্যাব সদস্য ও ৩ মাদক ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। র্যাব ঘটনাস্থল থেকে ৫৬ কেজি গাঁজা ও একটি বিদেশি পিস্তল উদ্ধার করে। সীমান্ত এলাকায় মাদকের পাচার, বাজার ও বিপণন উদ্বেগজনক হারে ছড়িয়ে পড়ায় চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে কথা বলা নিরাপদ মনে করছে না স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা চোরাচালানিদের দমনে সংশ্লিষ্টদের কঠোর হস্তক্ষেপের দাবি জানান।