পলাশ দেওয়ান (৪৫) একজন হাজিরা শ্রমিক। তার গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদীখান উপজেলার পূর্ব শিয়ালদী গ্রামে। কাজের সুবাদে ভাড়ায় থাকতেন গাজীপুরের শ্রীপুরের কেওয়া পর্বখ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাদের বাড়িতে। তিনি যখন যা কাজ পান তাই দিয়ে সংসারে দুটো ভাতের ব্যবস্থা করেন। এরই মধ্যে প্যারালাইজ হয়ে পড়েন। এখনো তিনি সেরে ওঠেননি। পরিবারের এমন উপায়ন্তর না পেয়ে বড় ছেলে অপু পড়াশোনা বন্ধ করে পোশাক কারখানায় চাকরি নেন। শিশু শ্রমিক হিসেবে যা বেতন পেতেন তাই দিয়ে চলছিল সংসার। সংসারের দায়িত্ব নেয়া সেই শিশু শ্রমিককে আজ শনিবার কারখানার ভেতরেই পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়। নিহত শিশু শ্রমিকের নাম অপু দেওয়ান (১৩)। কাজ করতেন গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বৈরাগীর চালা গ্রামের আনোয়ারা মান্নান পোশাক (টেক্সটাইল মিল) কারখানায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও কারখানা সূত্রে জানা যায়, শনিবার সকালে কারখানার নিচতলা রিং সেকশনে কাজ করার সময় এক সহকর্মী জোর করে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে দিলে পেট ফুলে যায় অপুর। খবর পেয়ে দ্রুত কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। হাসপাতালে পৌঁছার আগেই তার মৃত্যু হয়। ঘটনায় জড়িত অপুর এক কিশোর সহকর্মীকে (১৫) আটক করেছে পুলিশ। অভিযুক্তের বাড়ি দিনাজপুরের ফুলবাড়ি উপজেলার খড়েরের বাড়ি গ্রামে। ছয় মাস আগে তিনি এই কারখানায় চাকরি নেন বলে জানিয়েছেন কারখানার নিরাপত্তা প্রধান কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম। কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রধান কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সকালে এক শিফটের কাজ শেষের দিকে। এমন সময় শুনি নিচের তলায় হইচই। দ্রুত কাছে গিয়ে দেখি অন্য লেবার অপুর পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে দিয়েছে। এতে তার পেটে বাতাস জমে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। পরে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। শ্রীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জাবেদ পাটোয়ারি জানান, মুমূর্ষু অবস্থায় শিশুটিকে হাসপাতালে আনা হয়েছে। অবস্থার অবনতি বুঝে দ্রুত ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে। এদিকে সংসারের দায়িত্ব নেয়া অপুকে হারিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা পরিবারের। সরেজমিনে দেখা যায়, পুরো বাড়িতে নেমেছে শোকের ছায়া। অপুর মা জোছনা বেগম বিলাপ করছেন। তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমার পুতেরে (ছেলে) কি করছে গো। আমার পুতেরে আইন্না দেন। কি কষ্ট কইরাই আমার বুকের ধন মরছে গো।’ জোছনা বেগম কান্না করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিল। এ সময় দাদা ফুফুও কান্নায় ভেঙে পড়েন। পুরো এলাকাজুড়ে চলছে শোকের মাতম। অপুর চাচা শাকিল দেওয়ান বলেন, সকালে এমন খবর পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে অবস্থার অবনতি হলে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার সময় পথে অপু মারা যায়। প্রতিবেশী ভাড়াটিয়া নিবা রাণী জানান, তিন ছেলে নিয়ে বেশ কষ্টে দিনাতিপাত করেন রাজমিস্ত্রি পলাশ দেওয়ান। অপু দেওয়ান তাদের বড় সন্তান। সংসারের ব্যয় সামলাতে না পেরে স্কুল বন্ধ করে অপুকে চাকরিতে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘অপু খুবই ভালো ছেলে ছিল। চাকরির ফাঁকে সময় পেলে আমার ছেলের সঙ্গে চলাফেরা করত। আমার ছেলের দিকে তাকালে অপুকে মনে পড়ছে। এমন হত্যার উপযুক্ত বিচার হওয়া দরকার। অপুর আরও ছোট দুটি ভাই আছে। সে সংসারে ভরসা ছিল। সব ভরসা শেষ হয়ে গেল।’ এ বিষয়ে কারখানার দায়িত্বশীল (প্রশাসন) কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি। কারখানা গেটে গেলেও কারখানায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নিরাপত্তা কর্মীরা জানিয়েছে আপাতত কারখানায় দায়িত্বশীল কেউ নেই। পরে যোগাযোগ করতে বলেন সংবাদকর্মীদের। তবে, বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানান, কারখানায় সাড়ে আটশো নারী ও পুরুষ শ্রমিক রয়েছে। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশই শিশু। সবার বয়স বারো থেকে ষোলো বছরের মধ্যে। বেশির ভাগকেই ন্যায্য মজুরি দেয়া হয় না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রীপুর মডেল থানার ওসি (তদন্ত) মাহফুজ ইমতিয়াজ জানান, খবর পেয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত অভিযুক্ত শিশুটিকে আটক করা হয়েছে। লাশ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিহতের অনেক স্বজনই এখনো হাসপাতালেই ব্যস্ত আছেন।