ফুটবল খেলাটা ফুটবলাররা মাঠে খেললেও আসল খেলাটা কিন্তু খেলেন একজন কোচই। একজন বিশ্বমানের কোচই পারেন যেকোনো দলকে চূড়ায় তুলতে। আবার একজন কোচের ভুলে কৌশলে একটি বড় দলকেও নিচে নামিয়ে আনতে পারেন। কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিল কোচ তিতের বেশকিছু ভুল সিদ্ধান্তেই টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয় ব্রাজিলকে।
কাতার বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পর ব্রাজিল কোচের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান তিতে। ২০১৮ সালের পর কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে আরও একবার বিদায় নেয়ায়, তিতে সেই ব্যর্থতা নিজের কাঁধে নেয় আর ব্রাজিলের দায়িত্ব ছাড়েন। তবে ব্রাজিলের প্রধান কোচের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর পর কোচ নির্বাচনে বিপাকে পরেছে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন (সিবিএফ)। কারও কারও মত, এবার দেশি কোচ বাদ দিয়ে বিদেশি কোচ নিয়োগ দেয়া উচিত। আবারও কেউ কেউ এর বিপক্ষে। শেষ পর্যন্ত কোন পথে হাঁটবে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন?
গত বছর অনুষ্ঠিত হওয়া কাতার বিশ্বকাপে আরেকটি ব্যর্থতার সঙ্গী হয়ে টুর্নামেন্ট শেষ করেছে আন্তর্জাতিক ফুটবলে সবচেয়ে সফল দেশ ব্রাজিল। পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা শেষবার বিশ্বকাপ শিরোপা জিতেছিল ২০০২ সালে জার্মানিকে হারিয়ে। ২০০২ বিশ্বকাপের পর পাঁচটি কোচ বদল করেছে ব্রাজিল, তবে ফল পায়নি কেউ। ২০০২ বিশ্বকাপের পর ব্রাজিলের সর্বোচ্চ সাফল্য ২০১৪ সালে ঘরের মাঠে বিশ্বকাপে চতুর্থ স্থান অর্জন।
বারবার কোচ বদলিয়েও ফল না আসায়, এবার অনেকেই বলছেন বিদেশি কোচকে দায়িত্ব দিতে। তবে সবাই যে বিদেশি কোচের কথা ভাবছে তা নয়। একটা অংশ মনে করছেন, বিদেশি কোচ ব্রাজিলের ফুটবল–সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে পারে। এটাকে দেশের ফুটবলের জন্য অপমান বলেও মনে করছেন তারা। এমনই একজন ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি ফুটবলার রিভালদো। তিনি চান না একজন ব্রাজিলিয়ান ছাড়া অন্য কোনো দেশ থেকে কোচ নিয়োগ দিক ফেডারেশন।
এক সাক্ষাৎকারে রিভালদো বলেছিলেন, ‘আমাদের দলের জন্য বিদেশি কোচ নিয়ে আসা ব্রাজিলিয়ান কোচদের জন্য অসম্মানজনক। আমি মনে করি, আমাদের এমন কোচ আছে, যারা ব্রাজিল দলের দায়িত্ব নিতে এবং ভালোভাবে কাজ করতে সক্ষম।’ তবে ভিন্নমতও রয়েছে। এই যেমন ব্রাজিলের ২০০২ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক রোনালদো নাজারিও। রোনালদো আবার বিদেশি কোচ নিয়োগকে স্বাগত জানিয়েছেন।
রোনালদো নাজারিও বলেছেন, ‘আমি ব্রাজিলের কোচ হিসেবে গার্দিওলা, আনচেলত্তি এবং মরিনহোর মতো কোচ দেখতে পছন্দ করব।’ শুধু যে ব্রাজিলের ফুটবলাররা কোচ নিয়ে বিভক্ত তা নয়, ব্রাজিলের সমর্থকদের মধ্যেও এমন বিভক্ত দেখা গেছে।
এদিকে কিছুদিন আগেই ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন বিদেশি কোচকে স্বাগত জানিয়েছিল। এরপরই নানা গুঞ্জন শুরু হয় বিশ্বজুড়ে। বিদেশি কোচ নিয়োগে প্রথমেই নাম চলে আসে সাবেক রিয়াল মাদ্রিদের ফরাসি কোচ জিনেদিন জিদানের। এক সময়তো গুঞ্জনটা এতোটাই ছড়িয়ে পড়েছিল যে, ব্রাজিলের বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে জিদানকে কোচ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সেলেসাওরা।
তবে জিদানকে নিয়ে বেশিদূর গুঞ্জন আগায়নি। এরপরই জোসে মরিনহো, কার্লো আনচেলত্তি, লুইস এনরিকেসহ বেশ কয়েকটি নাম শোনা যায় ফুটবল পাড়ায়। তবে কারও নামই চূড়ান্ত হয়নি। তাদের নাম শুধু গুঞ্জন পর্যন্তই রয়ে গেছে।
এদিনে কিছুদিন আগেতো একটি সংবাদ আগুনের মতো ছড়িয়ে পরে গণমাধ্যমে। চলতি মৌসুম শেষে আনচেলত্তি রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব ছেড়ে ব্রাজিলের কোচের দায়িত্ব নিচ্ছেন। তাও তা ২০২৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত। তবে সেই ভুয়া সংবাদ বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, আনচেলত্তিকে কোচ করার বিষয় কোন কথাই হয়নি। ছড়িয়ে পরা সংবাদটি ভিত্তিহীন।
এদিকে বিদেশি কোচ দায়িত্ব না দেয়া বা দেশি কোচের ওপর আস্থা রাখার ব্যাপারে ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন এখন পর্যন্ত জানায়নি। যদিও তারা বিদেশি কোচকে স্বাগত জানিয়েছে, তবে আসলেই কি তারা বিদেশি কোচ নিয়োগ দেবে?
এদিকে ইউরোপে নানা বিদেশি কোচদের অধীনেই খেলে আসছে ব্রাজিলের সেরা সব খেলোয়াড়। থিয়াগো সিলভা, ভিনিসিউস জুনিয়র, নেইমার জুনিয়র, অ্যালিসন বেকার, রদ্রিগোসহ ব্রাজিলের একাদশে খেলা প্রায় সবাই ইউরোপের বড় বড় ক্লাবে খেলছেন। আর সেখানে তারা বিদেশি কোচদের চিন্তা–চেতনা ও দর্শনের সঙ্গে নিজেদের একীভূত করে নিয়েছেন। ফলে ব্রাজিলে দলে বিদেশি কোচ না নেয়াটা কতটা যুক্তিযুক্ত তা একটা প্রশ্ন থাকতেই পারে।
গত কয়েক দশকে ইউরোপে কোচিংয়ের ধরন অনেকটাই বদলে গেছে। ফুটবলীয় কৌশলেও এসেছে নানা ধরনের পরিবর্তন। সম্প্রতি জার্মান কোচদের আধিপত্য দেখা গেছে। যার সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না ব্রাজিলিয়ান কোচরা। ২০০২ সালের পর থেকে প্রতিটি বিশ্বকাপে ইউরোপীয় দলগুলোর কাছেই হেরে বিদায় নিতে হয়েছে ব্রাজিলকে। তাই কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে অনেকেই ভরসা রাখতে চাচ্ছেন ইউরোপীয় কোচে।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে। যদি ব্রাজিল ফুটবল ফেডারেশন একজন ব্রাজিলিয়ানকেই দলের প্রধান কোচের দায়িত্বে বসান, তাহলে তিনি কে হবেন এবং তিনি কতটা সফল হবেন। আর ব্রাজিলের কাউকে বসালেই কি ব্রাজিলের সেই সুন্দর খেলাটা ফিরে আসবে? আপনি খেলাটাকে যতই সুন্দর ভাবে খেলেন না কেন, যদি আপনি শেষ পর্যন্ত ফল না বের করে আনতে পারেন তাহলে আপনি ব্রাজিলিয়ানই হন বা বিদেশি কোচই হন না কেন আপনাকে কেউ মনে রাখবে না। তাই হয়তো অনেকেই এখন বিদেশি কাউকেই জাতীয় দলের কোচ হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন।