কক্সবাজারে আশ্রিত রোহিঙ্গা ১১ লাখ, জন্ম নেয় ২ লাখ শিশু
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের (রাখাইন) আরাকান রাজ্যে নির্যাতন ও গণহত্যার শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা দেশ ছাড়া হবার ৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে সমাবেশ ও মানববন্ধনের আয়োজন করেছেন রোহিঙ্গারা। গতকাল বৃহস্পতিবার দিবসটি উদযাপন উপলক্ষ্যে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর অধিকাংশ ক্যাম্পে, তাদের নিজের দেশ মিয়ানমারের সেনাবিহিনী ও মগ কর্তৃক ৫ বছর পূর্বে সংঘটিত অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, গণহত্যা ও জোরপূর্বক বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ায় পূর্ণ নাগরিক অধিকার দিয়ে তাদের দেশ মিয়ানমারে মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন ও বিচারের দাবিতে শান্তিপূর্ণ এ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। এ সময় ক্যাম্পের অভ্যন্তরে ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়োজিত সেবা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম প্রায় বন্ধ ছিল।
সরেজমিনে দেখাযায়, গতকাল সকাল দশটার দিকে উখিয়ার লম্বাশিয়া ১/ইস্ট সংলগ্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পূর্ব নির্ধারিত মানববন্ধন ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ‘গো ব্যাক হোম’ প্রতিপাদ্য নিয়ে মানববন্ধনে বক্তব্য রাখেন, ক্যাম্প ও বøকভিত্তিক কমিউনিটি রোহিঙ্গা নেতারা। এসময় উপস্থিত রোহিঙ্গারা ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ বলে শ্লোগান দেয়।
জানা যায়, গতকাল সমাবেশ করার কথা না থাকলেও রোহিঙ্গাদের মানববন্ধন করার কথা ছিল। কিন্তু নিপীড়নের বিচার দাবিতে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে মানববন্ধনে জড়ো হয়ে যান হাজারো রোহিঙ্গা। এতে মানববন্ধনগুলো সমাবেশে রূপ নেয়। সমাবেশে ২০১৭ সালে তাদের ওপর ঘটে যাওয়া বিভিন্ন নিপীড়নের সুষ্ঠু বিচারের দাবিসহ তাদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতিও ধন্যবাদ জানানো হয়।
২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট মাস্টার মুহিবুল্লাহ নেতৃত্বে ক্যাম্পে প্রথম বড় সমাবেশ করা হয়েছিল। পরে তিনি স্বগোত্রীয় সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। এবারের সমাবেশে কারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তা গোপন রাখা হয়েছে। এতে বক্তব্য রাখেন, মাস্টার জুবায়ের, মুহাম্মদ রফিক,সিরাজুল ইসলাম ও জুমালিকা বেগম নামের এক মহিলা। সূত্র জানায়, ক্যাম্পে এবারও সাধারণ রোহিঙ্গাদের সঙ্গে নিয়ে নেতৃত্বে দিচ্ছে মাস্টার মুহিবুল্লাহর হাতে গড়া সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি পিস ফর হিউম্যান রাইটস।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে এ রোহিঙ্গারা নিজ দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে। মায়ানমারে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। ক্যাম্পে কর্মরত কর্মকর্তারা জানিয়েছে, কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে বছরে ৩০ হাজার ৪০০ শিশু জন্মগ্রহণ করছে। সে হিসেবে গেল ৫ বছরে প্রায় ২ লাখ শিশু রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছে। তারা আরও জানিয়েছে, এ নিয়ে মহাবিপদে রয়েছে কক্সবাজারবাসী।
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পে তাদের বসবাস। এর বাহিরে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা। কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা ভাসানচরে পাঠানো হলেও অনেকেই পালিয়ে এসেছে। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বিলম্বিত হওয়ায় রোহিঙ্গাদের ভার এখন বাংলাদেশের উপর পড়েছে।
স¤প্রতি কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের প্রধান মিশেল ব্যাচেলেট ও জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত মিস নোয়েলিন হেজার। তাদের কাছে রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আকুতি জানিয়েছে। ক্যাম্প পরিদর্শনে তারা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রত্যাবাসনের জন্য ধৈর্য ধরার আহŸান জানিয়েছেন। তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন কখন কীভাবে হবে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি কেউ।
কক্সবাজার পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম জানান, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ৯৯টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। খুনাখুনি, অপহরণ, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মানব পাচার, অগ্নিসংযোগসহ ১৪ ধরনের অপরাধের সঙ্গে রোহিঙ্গারা জড়িয়ে পড়েছে। এসব কারণে ১ হাজার ৯০৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন সংস্থা ও স্থানীয়দের দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২০টির বেশি হত্যাকাÐের ঘটনা ঘটেছে।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াত বলেন, যে কোন সময় প্রত্যবাসনের প্রক্রিয়া শুরু করতে আমরা শতভাগ প্রস্তুত রয়েছি। প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও আপাতত ক্যাম্পে চাপ কমানোর জন্য ১ লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচর নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৩৫ হাজারের অধিক রোহিঙ্গাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার বারবার বলছে, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে নিয়ে যাবে। গেল ৫ বছর ধরে তারা কথা দিয়ে কথা রাখেনি। বাংলাদেশ সরকার বরাবরই প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের কাছে সক্রিয় ভ‚মিকা চাইছে। তবে জাতিসংঘসহ অন্যান্য সংস্থা ও দেশগুলো তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
জানসা যায়, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে সই করে মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে ২ দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়।
তবে বাংলাদেশ সরকার প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার যে কার্যক্রম হাতে নিয়েছে, অবশেষে তাতে যুক্ত হতে যাচ্ছে জাতিসংঘ।
একাধিক সূত্র বলছে, রোহিঙ্গা ইস্যু অনেক জটিল। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের রোহিঙ্গারা আসার কারণে শুধু এই সঙ্কট তৈরি হয়নি, এই সঙ্কট কয়েক দশকের পুরনো। ওই বছরের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের যে ঢল শুরু হয়, তাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ কক্সবাজারে চলে আসে। যুগ যুগ ধরে আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশ আবারও রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়। বিশ্ব স¤প্রদায় বাংলাদেশের জোরালো প্রশংসা করলেও এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে প্রত্যাশার চাপে রেখেছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য পশ্চিমা দেশসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলো মানবিক সহায়তা পাঠালেও গেল ৫ বছরে সঙ্কট সমাধান করতে এগিয়ে আসেনি।
এ ৫ বছরের মাথায় সেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। যার কারণে স্থানীয়রা হুমকির মুখে পড়েছে। তারা কথায় কথায় স্থানীয়দের ওপর হামলা করছে। তারা পুরো এলাকাজুড়ে মাদকের ডিপো আর খুন-খারাবি করছে। অপহরণ করে রোহিঙ্গাদের মুক্তিপণ আদায় এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গারা স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরবাড়িতে চুরি-ডাকাতি করছে। শুধু রোহিঙ্গাপ্রবণ সীমান্ত এলাকা উখিয়া-টেকনাফ নয়, কক্সবাজার শহর থেকে শুরু করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কায়দায় এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে জায়গা-জমি জবর দখল করছে।
এদিকে, চলিত বছরের ১৯ জুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৭ দফা দাবিতে উখিয়া-টেকনাফের ২৯টি ক্যাম্পে একযোগে সমাবেশ করেছিলো রোহিঙ্গারা। যার মধ্যে উখিয়ার ২৭টি ক্যাম্প এবং টেকনাফের ২৬ ও ২৭ নম্বর ক্যাম্পে নানারকম প্ল্যাকার্ড নিয়ে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে মিয়ানমারে দ্রæত প্রত্যাবাসনসহ ৭ দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। এসময় তারা বাড়ি ফিরতে ৭টি দাবি উত্থাপন করেন। তারা বলেছিলো, তারা আর এক মুহূর্তও বাংলাদেশে থাকতে চায় না। যেকোন উপায়ে দ্রæত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করতে হবে। মিয়ানমারে অন্যান্য জাতিগুলোর জন্য যেসব সুযোগ সুবিধা ও নিয়মকানুন রয়েছে সেগুলো রোহিঙ্গাদেরও দিতে হবে।
ক্যাম্পে কর্মরত কর্মকর্তারা জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের দ্রæত প্রত্যাবাসন করা না গেলে বাংলাদেশ তথা পর্যটন নগরী কক্সবাজার মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। হারিয়ে যাবে ঐতিহ্যের পর্যটন রাজধানী কক্সবাজার।