1. rashidarita21@gmail.com : bastobchitro :
বন্যার্তদের দিন কাটছে না খেয়ে | Bastob Chitro24
রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৮ পূর্বাহ্ন

বন্যার্তদের দিন কাটছে না খেয়ে

ঢাকা অফিস
  • আপডেট টাইম : সোমবার, ২০ জুন, ২০২২

উত্তরের সব নদনদীর পানি বাড়ছে আগামী ২৪ ঘণ্টা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা : বন্যায় মারা গেছেন দু’জন : সিলেট জেলায় সাড়ে ৪০০ আশ্রয়কেন্দ্রে ১ লাখেরও বেশি মানুষ : অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে গবাদিপশু

দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। উত্তরের সব নদনদীর পানি বাড়ছে। এতে উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, গাইবান্দা, রংপুরসহ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল এসব জেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণায় বন্যা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়েছে। ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি প্রতিদিন চরম বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছে। গ্রাম, কী শহর- সবই পানিতে তলিয়ে গেছে। সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণায় বানভাসী অনেক মানুষ আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই নিলেও সেখানে না খেয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। চরম দুর্দিনে দিন কাটছে তাদের। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে দিনে একবেলাও তাদের খাবার জুটছে না। দেখা মিলছে না জনপ্রতিনিধিদের। ত্রাণেরও কোনো দেখা নেই। পানিতে ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় অনেকে রান্নাবান্না করতে পারছেন না। দোকানপাট বন্ধ থাকায় শুকনো খাবারও কিনতে পারছেন না। খাদ্য সঙ্কটের পাশাপাশি বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট চরম। তাই পানি খেয়ে যে ক্ষুধার জ্বালা কিছুটা নিবারণ করবেন তাও পারছেন না। পয়ঃনিষ্কাশনেরও ভালো ব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে বন্যার্তদের, না খেয়ে চরম মানবেতর জীবন কাটছে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী কোথাও কোথাও উদ্ধার তৎপরতা এবং খাবার সরবরাহ করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, এখনো পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে ব্যস্ত থাকার কারণে অনেক স্থানে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।

সিলেট নগরীর শেখঘাটের ময়নুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রের দুটি ভবনে বসবাস করছে অর্ধশতাধিক পরিবার। নগরের শেখঘাট, কুয়ারপাড়, বিলপাড়সহ কয়েকটি এলাকা থেকে বাড়িঘর ছেড়ে এসে লোকজন উঠেছেন এই আশ্রয় কেন্দ্রে। অনেকটা গাদাগাদি করে বসবাস করছেন লোকজন। আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা কুয়ারপাড়ের তসলিমা জানিয়েছেন- গত দু’দিন ধরে তারা এখানে আছেন। আশপাশের লোকজন রান্না করা খাবার কখনো দিচ্ছেন, কখনো দিচ্ছেন না। দিনে এক বেলাও তারা খাবার পাচ্ছেন না। প্রশাসনের কেউ এসে ত্রাণ দেয়নি বলে জানিয়েছেন তিনি। শুকুর আলী নামের আরো এক বন্যার্ত জানান- তার ঘরে কোমর পানি। স্ত্রী, সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছেন। আজ সকালে এসে কয়েকটি পরিবার নতুন করে উঠেছে। শেখঘাট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঘাষিটুলা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি আশ্রয় কেন্দ্র পরিদর্শনকালে এমন চিত্রই চোখে পড়ে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলররা জানিয়েছেন- কিছু কিছু আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। এখনো সরকার থেকে পর্যাপ্ত ত্রাণ আসেনি। ১০ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তারেক আহমদ ও ১২ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সিকন্দর আলী জানান- আশ্রয়কেন্দ্রেও মানুষের ঠাঁই হচ্ছে না। পানিবন্দি লোকজনও জীবন বাঁচাতে এখন আশ্রয় কেন্দ্রে ছুটছেন। ফলে আশ্রয়কেন্দ্রে আসা লোকজনের সংখ্যা বাড়ছে। নগরের বাইরে সিলেট জেলায় সাড়ে ৪শ আশ্রয় কেন্দ্র রয়েছে। এসব আশ্রয় কেন্দ্রে ১ লাখেরও বেশি মানুষ না খেয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। অনেক আশ্রয় কেন্দ্রে গবাদি পশু ও মানুষ এক সঙ্গে বসবাস করছে।

উজানের ঢল অব্যাহত থাকার কারণে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়া যাচ্ছে না। সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার লুৎফুর রহমান জানিয়েছেন- আমরা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর এলাকার আশ্রয় কেন্দ্রে শুকনো খাবার পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। থানা এবং জেলা পুলিশের সদস্যরা নৌকাযোগে আশ্রয় কেন্দ্রে গিয়ে খাবার পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। সেনাবাহিনীর তরফ থেকে উদ্ধার কাজ পরিচালনার পাশাপাশি শুকনো খাবার ও ত্রান দেওয়া হচ্ছে। গতকাল সিলেটের বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরন করেন সেনা প্রধান এসএম শফি উদ্দিন আহমদ।

এদিকে গতকাল এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবার বড় ধরনের বন্যা হবে এমন আশঙ্কা আগেই করা হয়েছিল। কাজেই সেভাবে আগে থেকে আমাদের প্রস্তুতি আছে। বন্যায় মানুষের যাতে করে কষ্ট না হয়, সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনী থেকে শুরু করে সব প্রতিষ্ঠান উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা চালাচ্ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান গতকাল বলেন, সিলেট অঞ্চলে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১ লাখ ৫ হাজারের মতো মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া এখন পর্যন্ত বন্যায় মারা গেছেন দু’জন। একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী, সে স্রোতে ভেসে গেছে। আরেকজন বয়স্ক ব্যক্তি বিদ্যুৎস্পর্শে মারা গেছেন।

এদিকে বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্রের তথ্যানুযায়ী আগামী ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ সোমবার পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এ সময় কোথাও কোথাও বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে। মঙ্গলবার থেকে পানি কমতে থাকবে। এসময় উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে; কিন্তু মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হবে। বগুড়াসহ উত্তরের জেলাগুলোর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া প্রায় সব নদ-নদীর পানি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। উজানের ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতে তিস্তা, ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, বাঙ্গালী, ঘাঘট, করতোয়ায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। যমুুনা নদীর পানি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় বিপদসীমার ১৯ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে প্লাবিত হয়েছে নদী তীরবর্তী নিচু এলাকার বসতবাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং চরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ ফসলি জমি।

সিলেট ব্যুরো জানায়, সুরমার ভয়ংকর রূপ, স্তিমিত হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিকে ফিরছে। সিলেটের বিভিন্ন উপজেলার পাশাপাশি পানি কমেছে নগরীর আশপাশ এলাকায়। টানা বৃষ্টিপাত আর উজানি ঢলে ইতোমধ্যেই সিলেটের সবকটি অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত। পানিবন্দি থেকে জীবনযাপন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। তবে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় কমছে আতংক। সুরমার অত্যাচারের এমন তাণ্ডব অতীতে প্রত্যক্ষ করেনি মানুষ। তলদেশ ভরাট, ধারণ ক্ষমতাহীন সুরমা কতটা বেপরোয়া হতে পারে গোটা সিলেটবাসী নিজ চোখে দেখলো। উজানের ঢল বাস্তবতা হলেও দেশের অভ্যন্তরে সুরমা খননে কোন উদ্যোগ না নেয়ায় এমনটি হয়েছে বলে অভিমত বিজ্ঞদের। কিন্তু কর্ণপাত করেনি কর্তৃপক্ষ। বড়বড় প্রকল্পে বালুর পাহাড় ভরে দিলেও সেই বালু সুরমার বুক থেকে নিয়ে আসলে আজ সুরমা এমন আচরণ করত না। অথচ প্রকৃতি বিগড়ে সেই বদলা দিলো গোটা সিলেটকে। পানি কমতে শুরু করলও ক্ষত বিক্ষত গোটা সিলেট। অকল্পনীয় বন্যায় অপূরণীয় ক্ষতির মুখে গোটা সিলেটবাসী। ঘরে মানুষের আর্তনাদ। আশ্রয়হীন মানুষ। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। গতকাল সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত খুব কম পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়েছে সিলেটে। আজ সোমবার থেকে আকাশে মেঘের পরিমাণ কমে আসবে। বৃষ্টিপাতও তুলনামূলক কমে যাবে। সেই সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে জানান সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ চৌধুরী। এদিকে, সিলেটের বন্যার্তদের দুর্দশা প্রত্যক্ষে কাল সিলেট আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সিলেটে বন্যাকবলিত কোম্পানীগঞ্জ পরিদর্শন করেছেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমদ। এসময় বলেছেন, পরিস্থিতি মোকাবেলা প্রধানমন্ত্রীর স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। এদিকে বন্যাকবলিত এলাকায় সংযোগ স্থাপন করা হলো বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের। কারন বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে গোটা সিলেট। সেই সাথে মোবাইল নেটওয়ার্ক মুখ থুবড়ে পড়ে। রেল যোগযোগ স্বাভাবিক হয়েছে সিলেটের সাথে সারাদেশের। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে জেলার ১০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে ।

স্টাফ রিপোর্টার, গাইবান্ধা থেকে জানান, জেলার সবকয়টি নদ নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, তিস্তা, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘন্টায় গতকাল বিকেল পর্যন্ত যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার ১৭ সে.মি, তিস্তা ২৮ সে.মি ও করতোয়া ১৪৫ সে.মি. নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে ঘাঘট নদীর পানি বিপৎসীমার ১৮ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে নদীর দু’ধারের লোকজন বন্যা আতঙ্কে রয়েছে।

সুনামগঞ্জ জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলা শহরে কোথাও দাঁড়ানোর মাটি নেই। এখনো ৪ থেকে ৬ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে সুনামগঞ্জ শহর। দোকানপাট, অফিস-আদালত সব জায়গায় পানিতে টইটুম্বর। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো সুযোগ নেই। স্কুল-কলেজ, মসজিদ, অফিস-আদালতসহ উঁচু সেতুসহ শহরের বহুতল ভবনগুলোতে কয়েক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে বানভাসি মানুষ। কোনো কোনো স্থানে এক ঘরে ২০ থেকে ৩০ জন পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছেন। একে অন্যের জন্য এগিয়ে এসেছে মানুষ। যাঁদের উঁচু বাড়ি বা বহুতল ভবন আছে, তারা অন্যদের আশ্রয় ও খাবার দিয়ে সহায়তা করছেন। বহুতল প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটি আশ্রয়কেন্দ্র। সুনামগঞ্জে গত চার দিন ধরে বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন । মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও ঠিকমতো কাজ করছে না। বিচ্ছিন্ন এই জনপদে এখন খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট। মোমবাতি পাওয়া যাচ্ছে না। মানুষ ইচ্ছা করলেও জিনিসপত্র কিনতে পারছে না। শহরের সব দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তলিয়ে আছে। মানুষের এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন খাবার আর বিশুদ্ধ পানি। একে তো জিনিসপত্র নেই, তার ওপর রান্নাবান্নারও সমস্যা। বাসাবাড়ির চুলা পানির নিচে। তিন দিন ধরে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন সুনামগঞ্জ জেলা শহর। বিদ্যুৎ ও মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক না থাকায় শহরসহ বিভিন্ন উপজেলার মানুষের সঙ্গে তাদের স্বজন ও পরিবারের লোকজনও যোগাযোগ করতে পারছেন না। তবে গতকাল থেকে বন্যার পানি কিছুটা কমছে। কিছু কিছু বাসাবাড়ির ছাদে মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট পাওয়া যাচ্ছে। জেলা শহরের প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, সুনামগঞ্জে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা। এত পানি, পাহাড়ি ঢল আগে কখনো দেখেনি মানুষ। বন্যায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা। এসব উপজেলা ভারত সীমান্তঘেঁষা।

লালমনিরহাট জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলার পাউবো জানায়, তিস্তা ও ধরলার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়া তিস্তা ও ধরলা নদীর অববাহিকায় মাইকিং করে করে সর্তকতা জারি করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ইনকিলাবকে জানান, চরের মানুষ যাতে প্রানহানীর শিকার না হয়, বিপদে না পড়ে সেই কারণে মাইকিং করে সর্তক জারি করা হয়েছে। এদিকে অব্যাহত পানিবৃদ্ধির কারণে জেলার পাঁচ উপজেলার তিস্তা ধরলার তীরবর্তী ৩০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তিস্তার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে খুলে দিয়ে পানি নিয়ন্ত্রণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। গতকাল সকাল ৬টায় হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানীতে অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি ৫২.৭২ সেন্টিমিটারে প্রবাহিত হচ্ছে (স্বাভাবিক ৫২.৬০) যা বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত দু’দিন পরিবারগুলো রান্না করতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকেই উঁচু স্থানে চুলা জ্বালিয়ে কোনরকম রান্না করে এক বেলা খেয়ে জীবন যাপন করছেন। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মো. আবু জাফর ইনকিলাবকে জানান, বন্যা কবলিত জেলার পাঁচ উপজেলায় ১৫০ মেট্রিকটন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা গত শনিবার বিতরণ করা হয়েছে। বন্যা কবলিত যেসব এলাকা আছে সেগুলোতে শুকনো খাবার বিতরণের অব্যাহত রয়েছে।

শেরপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা বন্যাকবলিত হয় পড়েছে। পানি বন্দি অবস্থায় দুর্ভোগ পোহাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এক সপ্তাহ পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় মানুষের দুর্ভোগ শেষ হতে না হতেই আবার পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় চরম দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। পাহাড়ি নদী মহারশী ও সোমেশ্বরীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে শেরপুরের ঝিনাইগাতীর ৫, শ্রীবরদীর ২ ইউনিয়ন, চেল্লাখালি ও ভোগাই নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নালিতাবাড়ীর ৫ ও শেরপুর সদরের ১ ইউনিয়নসহ জেলার ১৩টি ইউনিয়ন বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এসব এলাকার অন্তত ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে।
টাঙ্গাইল জেলা সংবাদদাতা জানান, কালিহাতী উপজেলার সল্লা ইউনিয়নের আনালিয়াবাড়ী গ্রামে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ভেঙে প্রায় ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গতকাল ভোরে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এ ভাঙনের সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে সল্লা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের আনালিয়াবাড়ীর এ বাঁধটি প্রায় একশ’ মিটার ভেঙে গেছে। এতে করে নরদহি, আনালিয়াবাড়ী, ভাওয়াল, দেউপুর, বিলছাইয়া, ভাবলা ও দেউলাবাড়ীসহ প্রায় ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কালিহাতী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) সাজ্জাদ হোসেন তালুকদার জানান, আনালিয়াবাড়ীর এ বাঁধটি ভেঙে যাওয়ার ফলে ওই এলাকার প্রায় ১০ থেকে ১৫ হেক্টর জমির পাট ফসলের ক্ষতি হয়েছে।

মৌলভীবাজার জেলা সংবাদদাতা জানান, জেলায় গত ৩দিনের টানা ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢল এবং কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা দেখা দিয়েছে। বন্যায় জেলায় ৩৫ ইউনিয়নের ৩২৫ গ্রামের প্রায় ২ লাখ ৭ হাজার ৫০০ মানুষ পানিবন্ধি রয়েছেন। সময় যত যাচ্ছে ততই বাড়ছে বন্যার্তদের পরিসংখ্যান। হাকালুকি, কাউয়াদিঘিও হাইল হাওর ছাড়াও জেলার মনু, ধলাই, ফানাই, কন্টিনালা, জুড়ী ও কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারি বৃষ্টির কারণে বড়লেখায় পাহাড় ধসে ১ জন নিহত ও ১জন আহত হয়েছেন। বিদ্যুতের সাব স্টেশনে বন্যার পানি প্রবেশ করায় ইতোমধ্যে কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখার অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। কুলাউড়া-বড়লেখা আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্নস্থান বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে।

জামালপুর জেলা সংবাদদতা জানান, জামালপুরের যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল সকালে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এতে জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ ও বকশিগঞ্জের নিম্নাঞ্চলে ঢুকতে শুরু করেছে বন্যার পানি। এছাড়াও দেওয়ানগঞ্জের গুজিমারি গুচ্ছগ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ওই গ্রামের লোকজন আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

কুড়িগ্রাম জেলা সংবাদদাতা জানান, গত তিনদিনে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। গতকাল সকালে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৩২ সেন্টিমিটার এবং ধরলা নদীর পানি সেতু পয়েন্টে ২৭ সেন্টিমিটার বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বাড়ার সাথে সাথে তলিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সেই সাথে বানভাসী এলাকায় দেখা দিয়েছে শুকনো খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকট। উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তিনদিনে অস্বাভাবিকভাবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার ৯ উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নের প্রায় ১৫০টি গ্রামের প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পরেছে।

চিলমারী (কুড়িগ্রাম) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, চিলমারী উপজেলার বিভিন্ন এলাকা নদ-নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় তলিয়ে যাচ্ছে। বাড়তে শুরু করেছে দুভোর্গ। বিশেষ করে চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপাকে পড়েছে নিম্নাঞ্চল, দ্বীপচর ও নদনদী তীরবর্তী এলাকার মনুষজন। গত ২৪ ঘন্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে চিলমারী পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৬ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল গতকাল বেলা ১২টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকায় বিপাকে পড়েছে মানুষজন।

নীলফামারী জেলা সংবাদদাতা জানান, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে তিস্তা নদীর পানি আবারও হু হু করে বাড়তে শুরু করেছে। গতকাল সকাল ৬টা থেকে তিস্তা নদীর পানি নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে যাচ্ছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের পানি পরিমাপক নূরুল ইসলাম জানান, গত শনিবার বিকেল থেকে তিস্তার পানি বাড়তে থাকে এবং গতকাল ৬টা থেকে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরপর থেকে পানি কমতে থাকে। সকাল ৯টায় পানি কমে বিপৎসীমার ৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে এবং দুপুর ১২টায় বিপৎসীমার ৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয় তিস্তার পানি। এদিকে পানির গতি নিয়ন্ত্রনে রাখতে তিস্তা ব্যারেজের ৪৪টি জলকপাট খুলে রাখা হয়েছে।

সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, গত এক সপ্তাহ থেকে অবিরাম ভারি বর্ষণ ও নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। ইতোমধ্যেই ৭০০ পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নিমজ্জিত হয়েছে পাটক্ষেতসহ বিভিন্ন সবজিক্ষেত। এছাড়া উপজেলার তারাপুর, বেলকা, হরিপুর, চন্ডিপুর, শ্রীপুর ও কাপাসিয়া ইউনিয়নের উপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর বিভিন্ন চরে বন্যার পানি উঠেছে। গত কয়েক দিনের ঘন ঘন প্রবল বর্ষণে উপজেলার নিম্নাঞ্চলসমূহ পানিতে টইটুম্বুর হলেও এখন তা বড় বন্যায় রুপ নেয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

নবীগঞ্জ (হবিগঞ্জ) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ভারতের পাহাড়ি ঢল ও অবিরাম বৃষ্টির ফলে কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছুস্থানে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। গত কয়েকদিনের আবিরাম বৃষ্টির ফলে ও উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে আসার কারনে কুশিয়ারা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ উপচে বন্যার পানি প্রবেশ করছে। নাসিরনগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, ভারি বর্ষণ আর উজান এলাকার পানি নেমে আসায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার মেঘনা, ধলেশ্বরী আর লঙ্গন নদীতে হু হু করে করে বাড়ছে বন্যার পানি। মাত্র তিন দিনের ব্যবধানেই স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কায় দেখা দিয়েছে নাসিরনগর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে। এরি মধ্যে নিম্নাঞ্চলের অনেকেই পানিবন্দি হয়ে পরেছে। এরই মধ্যে রাস্তাঘাট আর আমন ধানের ফসলি জমি তলিয়ে গেছে পানিতে। চরম আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে মানুষের।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
এই ওয়েবসাইটের লেখা ও ছবি অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি।
প্রযুক্তি সহায়তায়: রিহোস্ট বিডি