ফের আলোচনায় ভোজ্যতেল। গত বৃহস্পতিবার আগামী ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার দিনে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলে ৭ টাকা বাড়িয়ে ২০৫ টাকা নির্ধারণ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এছাড়া খোলা তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে লিটারে ৫ টাকা। বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব খন্দকার নূরুল হক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই দাম জানানো হয়েছে। প্রস্তাবিত দাম অনুযায়ী প্রতিলিটার খোলা সয়াবিন তেল ভোক্তা পর্যায়ে ১৮৫ টাকা করা হয়েছে। যা আগে ছিল ১৮০ টাকা। আর এক লিটার সয়াবিন তেলের বোতল ২০৫ টাকা করা হয়েছে। যা আগে ছিল ১৯৮ টাকা। তবে ৫ লিটারের বোতল ৯৯৭ টাকা করা হয়েছে। এতে সর্বস্তরের ক্রেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা না ভেবে বরং শুধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ নিয়েই ভাবছেন বলে মনে করেন তারা। এছাড়া মন্ত্রণালয় পরিচালনায় মন্ত্রীর যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
এক সপ্তাহ আগেই বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ভোজ্যতেলের দাম বাড়বে না বরং কমবে। অথচ বাজারে তার কথার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। শুধু এবারই নয়, সাম্প্রতিক অতীত দৃশ্যপট পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাণিজ্যমন্ত্রী যতবারই বাজার স্থিতিশীল রাখা, কঠোর মনিটরিং করা অথবা দাম কমানোর আশ্বাস দিয়েছেনÑ প্রতিবারই দাম বেড়েছে। নতুন করে দাম বাড়ানোর ১ মাস আগে গত ৫ মে ভোজ্যতেলের দাম ১৬০ টাকা থেকে লিটারপ্রতি ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করা হয়। এর আগে গত রমজান মাসকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ভোজ্যতেল আমদানি পর্যায়ে ১০ শতাংশ, উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। সে প্রস্তাব গৃহীতও হয়েছিল। তবে তাতে কয়েকদিনের জন্য বাজার শান্ত হলেও দীর্ঘমেয়াদে তার সুফল পাননি সাধারণ জনগণ। এর পুরো সুফল একচেটিয়া ভোগ করেছে ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন সময়ে মজুতদারি, অতিরিক্ত দামে বিক্রির অভিযোগে অভিযান পরিচালনা করে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর। তাতেও থেমে থাকেনি অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য।
সাম্প্রতিক সময়ে সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে ব্যবসায়ীদের বিশ্বাস করা ভুল ছিল বলেও মন্তব্য করেছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেছিলেন, এটা আমার ব্যর্থতা। ভোজ্যতেলের দাম না বাড়ানো এবং সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে অনুরোধের পরও ব্যবসায়ীরা কথা রাখেননি। এছাড়া তিনি ভোজ্যতেলের বিকল্প হিসেবে সরিষা ও রাইস ব্রান তেলের ব্যবহার বাড়ানোর কথাও বলেছিলেন। তবে বাস্তবে এর কিছুই ঘটেনি। বরং যখনই বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠক হয়েছে, তারপরই বাজারে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে।
বর্তমানে তেলের লিটার ২০৫ টাকা নির্ধারণ করা হলেও চলতি বছরের শুরুর দিকে এই দাম ছিল ১৩৬ টাকা। এরপর থেকেই ধাপে ধাপে কয়েকদিন পরপরই বেড়েছে এই পণ্যের দাম। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই প্রতি লিটারে ৮০ টাকা দাম বাড়ল সয়াবিনের। বাজার নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেয়া বাণিজ্যমন্ত্রীর কথা ব্যবসায়ীরা যে কোনো গুরুত্ব দেয় না, তা এরই মধ্যে বারবার প্রমাণিত হয়েছে। প্রতিবারই ব্যবসায়ীদের জন্য লাভজনক পরিস্থিতি তৈরি হলেও সাধারণের টিকে থাকাই এখন দায়। নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশে কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয়ার পরপরই সয়াবিনের দরবৃদ্ধি বাজেটের দর্শনের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। অন্যদিকে এতে প্রান্তিক পর্যায়ের জনগণের ওপর চাপ আরও বৃদ্ধি পাবে বলেও মত তাদের।
শতকরা ৯০ ভাগ আমদানিনির্ভর এই পণ্যটির বাজারে মূলত সিটি গ্রুপ, টিকে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে আছে। এছাড়া বেসরকারি কারখানাগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) কিছু পরিমাণ সয়াবিন তেল আমদানি করে। এখন পর্যন্ত কিছু ছোট ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালিত হলেও পর্দার আড়ালেই থেকে গেছে এই শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো। অজ্ঞাত কারণে কখনোই এদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান পরিচালিত হয় না বলে মত অনেক সাধারণ ভোক্তাদের।
অনেক ভোক্তা তাদের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগসাজস করেই নিয়মিত ভিত্তিতে এ পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। এছাড়া বাণিজ্যমন্ত্রীকে ব্যবসায়ীবান্ধব কম হয়ে জনবান্ধব হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা। তারা জানিয়েছেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও আয় বাড়েনি। প্রতিটি দিনই নতুন করে খরচ চালানো নিয়ে ভাবতে হয়। আজকে তেলের দাম বাড়লে, কালকে বাড়ে পেঁয়াজের দাম।
সয়াবিন তেলের দাম বাড়ালেও অবশ্য পাম তেলের দাম কিছুটা কমিয়ে প্রতি লিটার ১৫৮ টাকা করা হয়েছে। যা আগে ছিল ১৭২ টাকা। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল মিল গেটে ১৮০ টাকা, পরিবেশক পর্যায়ে ১৮২ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ১৮৫ টাকায় বিক্রি হবে। আর ১ লিটারের বোতল মিলে ১৯৫ টাকা, পরিবেশকে ১৯৯ টাকা এবং খুচরায় ২০৫ টাকা, ৫ লিটারের বোতল মিলে ৯৫২ টাকা, পরিবেশকে ৯৭২ টাকা এবং ভোক্তায় ৯৯৭ টাকা। পাম তেল মিলে ১৫৩ টাকা, পরিবেশকে ১৫৫ টাকা এবং খুচরায় ১৫৮ টাকা লিটার নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশিতে বিক্রি করা হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।