অর্ধযুগের বেশি সময় চরম জনদুর্ভোগের পর সংস্কার ও সম্প্রসারণ শেষ হয়েছে চট্টগ্রাম নগরীর পোর্ট কানেকটিং রোডের। বর্তমানে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ চলছে। খুব শিগগির গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। কিন্তু তার আগেই বেপরোয়া দখলবাজিতে সড়কের বেহালদশা। প্রায় ছয় কিলোমিটার সড়কটিতে যানজট এখন নিত্যদিনের। দেশের প্রধান চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের সাথে জাতীয় অর্থনীতির লাইফলাইন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সংযোগ সৃষ্টি করেছে পোর্ট কানেকটিং রোড।
প্রতিদিন এ সড়ক হয়ে আমদানি-রফতানি পণ্যবাহি ১৫ থেকে ২০ হাজার ভারি যানবাহন চলাচল করে। গণপরিবহনে চলাচল করে লাখো মানুষ। ওই এলাকায় রয়েছে স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আবাসিক এলাকা। রয়েছে সরকারি বেসরকারি অসংখ্য গুদাম, বাজার ও বাণিজ্যিক স্থাপনা। সড়কের পাশেই সাগরিকা শিল্পাঞ্চল, বাস টার্মিনাল। কিন্তু সড়কটির দুইপাশ দখল করে ভারি যানবাহন পার্কিং করায় যানবাহন চলাচল মারাত্মক বিঘ্নিত হচ্ছে। আর তাতে অসহনীয় যানজটে আটকা পড়ছে শত শত পণ্যবাহি যানবাহন। এতে সার্বিক আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ছে।
পোর্ট কানেকটিং রোডের বেহাল অবস্থার প্রভাব পড়েছে আশপাশের প্রতিটি সড়কে। মহানগরীর একাংশ স্থবির হয়ে পড়ছে যানজটে। শত কোটি টাকা ব্যয়ে আলোচিত এ সড়কটির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কাজ শেষ না করতেই দখলবাজিতে এমন বেহাল অবস্থায় উন্নয়নের সুফল নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। স্থানীয়দের প্রশ্ন শতকোটি টাকার সুফল কোথায়।
চট্টগ্রাম বন্দর লাগোয়া নিমতলা বিশ^রোড থেকে শুরু পোর্ট কানেকটিং রোড। এটি সাগরিকা সিটি গেইট হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাথে সংযোগ সৃষ্টি করেছে। চট্টগ্রাম বন্দর অভিমুখী আমদানি-রফতানি পণ্যবাহি ভারি যানবাহন চলাচল করে এ সড়ক হয়ে।
সরেজমিন দেখা যায়, নিমতলা থেকে বড়পোল পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার অংশে সড়কের দুই পাশে শত শত ভারি যানবাহন পার্কিং করে রাখা হচ্ছে। নিমতলা পার হয়ে মহেশখাল ব্রিজের কাছে যেতে মনে হবে এটি সড়ক নয় ভারি যানবাহনের টার্মিনাল। সড়কের দুই পাশ দখল করে কাভার্ডভ্যান, ট্রাক, লরি ও ট্রেইলর পার্কিং করায় মূল সড়ক সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়েছে। সরুপথে ভারি যানবাহন ও গণপরিবহন চলতে গিয়ে তীব্র যানজট হচ্ছে।
নিমতলা থেকে বড়পোল পর্যন্ত পৌঁছাতে আধা ঘণ্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। পোর্ট কানেকটিং রোড বিমানবন্দর সড়কের সাথে মিলিত হয়েছে। ওই সড়কে চলছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজ। কাজে ধীরগতির কারণে মহানগরীর প্রধান সড়কটির এখন বেহাল দশা। পোর্ট কানেকটিং রোডের জটের ধাক্কা লাগছে এ সড়কে। এর প্রভাবে টোল রোড, ডি টি রোড থেকে শুরু করে এ কে খান গেইট ও জাকির হোসেন সড়ক পর্যন্ত যানজট হচ্ছে। পোর্ট কানেকটিং রোডের দুই পাশের বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা সড়কটির এমন বেহাল দশায় ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন।
স্থানীয়রা জানান, সড়কটি সংস্কারের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলনের মুখে সংস্কার কাজ শুরু হলেও কাজে ধীরগতির কারণে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ে। দ্রুত কাজ শেষ করতেও স্থানীয়দের রাস্তায় নেমে আন্দোলন করতে হয়েছে। প্রায় অর্ধযুগ সময় সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় স্থানীয়দের। এখন সড়কটির উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ কাজ শেষ হলেও এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। বেপরোয়া দখলে সড়কটি এখন টার্মিনালে পরিণত হয়েছে।
নিমতলা থেকে বড়পোল পর্যন্ত ভারি যানবাহন রেখে সড়ক দখল করা হয়েছে। বড়পোল থেকে হালিশহর হয়ে সাগরিকা পর্যন্ত সড়ক দখল করে পার্কিংয়ের পাশাপাশি অবৈধ দোকানপাট গড়ে উঠেছে। রাস্তা দখল করে রাখা হচ্ছে নির্মাণ সামগ্রী। এতে স্বাভাবিক যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। এজন্য ট্রাফিক বিভাগকে দায়ী করেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, পুলিশের নাকের ডগায় স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী রাস্তায় অবৈধ পার্কিংয়ের সুযোগ করে দিচ্ছে। বিনিময়ে তারা অবৈধ সুযোগ-সুবিধাও আদায় করে নিচ্ছে। ট্রাফিক পুলিশ সতর্ক থাকলেও সড়কটির এমন বেহাল দশা হতো না।
উদ্বোধনের আগে সড়কে দখলবাজির বিষয়টি স্বীকার করেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (ট্রাফিক-বন্দর) শাকিলা সুলতানা। তিনি বলেন, অবৈধভাবেই সেখানে পার্কিং হচ্ছে। তবে আমরা নিয়মিত অভিযান চালিয়ে এসব যানবাহন সরিয়ে দিচ্ছি। মহানগরীতে বিশেষ করে বন্দর এলাকায় পর্যাপ্ত টার্মিনাল কিংবা পার্কিং স্পেস না থাকায় পণ্যবাহি এসব ভারি যানবাহন বাধ্য হয়েই সড়কে পার্কিং করছে। এতে যানজটে সাধারণ মানুষের যেমন কষ্ট হচ্ছে তেমনি ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণে পুলিশ সদস্যেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে।
জাপানের দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে প্রায় একশ কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কটির উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। ২০১৭ সালের ২০ নভেম্বর শুরু করা হয় সংস্কার কাজ। তাহের ব্রাদার্স, মেসার্স মঞ্জুরুল আলম কনষ্ট্রাকশন (ম্যাক), মেসার্স রানা বিল্ডার্স লিমিটেড-সালেহ আহমেদ (জেভি) নামে চারটি প্রতিষ্ঠান পৃথক পৃথক লটে ৫.৬৫ কিলোমিটার সড়কটির উন্নয়ন কাজের দায়িত্ব পায়। দুই বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার টার্গেট করা হলেও পাঁচ বছরের বেশি সময় পার হয়ে যায়। কাজ অসম্পন্ন রেখে পালিয়ে যায় ঠিকাদার। দফায় দফায় বদল করতে হয় ঠিকাদার।
কাজের বেহাল দশায় জনদুর্ভোগের কারণে সরকারের একাধিক মন্ত্রী চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন। প্রায় পাঁচ বছরের বেশি সময় পর সড়কটির উন্নয়ন কাজ এখন শেষের পথে। প্রকল্প পরিচালক ও সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলী আনোয়ার জাহিন জানান, পোর্ট কানেকটিং রোডের সম্প্রসারণ ও সংস্কার কাজ একেবারে শেষের দিকে। এখন চলছে সৌন্দর্যবর্ধন। খুব শিগগির সিটি মেয়র সড়কটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। ঠিকাদারের অবহেলা ও অদক্ষতার কারণে কাজে দেরি হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে আলোচিত এই সড়কের উন্নয়ন কাজ অসমাপ্ত রেখে ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের ৪০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ঠিকাদির প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যাংকের কর্মকর্তাসহ আটজনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- সড়কের কার্যাদেশ পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স রানা বিল্ডার্স থেকে সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ পাওয়া কুমিল্লার মো. জাকির হোসেন, মেসার্স রানা বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলম এবং ফেনী সদর এলাকার বাসিন্দা ছালেহ আহাম্মদ।
এছাড়া ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড-ইউসিবিএল কুমিল্লা শাখার সাবেক এফভিপি এবং ব্যবস্থাপক মো. সারোয়ার আলম (বর্তমানে প্রধান শাখায়), সহকারী ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনিসুজ্জামান, এফএভিপি ছাইফুল আলম মজুমদার, ব্যাংকটির খুলশী শাখার জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মকামে মাহমুদুল ইসলাম আরেফিন ও ইউসিবিএল চট্টগ্রাম আঞ্চলিক অফিসের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা দেবু বোসকেও আসামি করা হয়েছে।