নিত্যপণ্য আমদানিতে একক দেশ নির্ভরতায় পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। কোনো পণ্য শুধু একটি দেশ থেকে আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটানো এখন চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে এখন নানা সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
কোনো দেশ তাদের অভ্যন্তরীণ কারণে রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বা উৎপাদন কম হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বাজারে। সংশ্লিষ্ট পণ্যের বাজার বেসামাল হয়ে পড়ছে। এতে পণ্যের দাম চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তখন পরিস্থিতি সরকারের পক্ষেও সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
শনিবার ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দিলে আন্তর্জাতিক বাজারে এর দাম দুদিনে ৩৮ শতাংশ বেড়ে যায়। দেশের বাজারেও ভোজ্যতেলে দাম বাড়তে থাকে। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে একই অবস্থা দেখা দেয়। পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
এ ঝুঁকি কমাতে আমদানি নির্ভর পণ্যগুলো কোনো একক দেশের ওপর নির্ভর না করে বেশ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানি করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বাজার বিশ্লেষকরা। তারা বলেছেন, নানা কারণে কোনো একটি দেশের উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। একই সঙ্গে বিভিন্ন কারণে রপ্তানিও বন্ধ করতে পারে। এতে করে দেশের বাজারে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয় সেজন্য বিভিন্ন দেশ থেকে একই পণ্য আমদানির উদ্যোগ নিতে হবে। এতে কোনো দেশ থেকে আমদানিতে সমস্যা হলে বিকল্প দেশগুলো থেকে কিছু কিছু করে আমদানি বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে খরচ বেশি হলেও তবুও নিত্যপণ্য আমদানিতে এ ধরনের বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরি।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে একক দেশ নির্ভরতা পরিহার করেও একাধিক দেশ থেকে পণ্য আমদানির উদ্যোগ নিতে হবে। এতে কোনো দেশে সমস্যা হলে অন্য দেশ থেকে আমদানি বাড়ানো সম্ভব হবে। সংকটে হঠাৎ করে নতুন করে কোনো দেশ থেকে আমদানি কঠিন হয়ে পড়তে পারে। এজন্য আগে থেকেই আমদানির বিকল্প ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাব করেছে সংস্থাটি।
সূত্র জানায়, শনিবার ইন্দোনেশিয়া পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দিলে দেশের বাজারে সয়াবিন তেলসহ পাম অয়েলের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। সরকারের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ১৬০ টাকা ও পাম অয়েল ১৩০ টাকা করে বিক্রি করার কথা। কিন্তু মঙ্গলবার প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ২০০ টাকা ও পাম অয়েল ১৭৫ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার ওই ঘোষণার পর আন্তর্জাতিক বাজারেও এর দাম বেড়ে যায়। এক বছর আগে প্রতি টন পাম অয়েলের দাম ছিল ৯৬০ ডলার। বৃহস্পতিবার ছিল ১ হাজার ১৮০ ডলার। এখন তা বেড়ে ১ হাজার ৮০০ ডলারে উঠেছে। সয়াবিন তেলের দামও বেড়ে ১ হাজার ৭০০ ডলার থেকে ১ হাজার ৯২০ ডলার হয়েছে।
বিশ্বব্যাপী পাম অয়েলের ৩৯ শতাংশই রপ্তানি করে ইন্দোনেশিয়া। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর সয়াবিন তেলের দাম বাড়ার কারণে ইন্দোনেশিয়ার বাজারে ভোজ্যতেলের দাম হু হু করে বেড়ে যায়। তাদের দেশের বাজারে তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক যখন রপ্তানি বন্ধ করল তখন বিশ্ববাজারেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
দেশে বছরে শিল্প ও খাদ্য মিলে সাড়ে ২৪ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ২০ লাখ টন ব্যবহৃত হয় খাদ্য হিসাবে। বাকি সাড়ে ৪ লাখ টন ব্যবহৃত হয় শিল্প খাতে। দেশে মোট চাহিদার ৬৭ শতাংশই পাম অয়েল দিয়ে মেটানো হয়। বাংলাদেশ প্রতিবছর গড়ে ১৬ লাখ টন পাম অয়েল ও সাড়ে ৮ লাখ টন সয়াবিন তেল আমদানি করে। অর্থাৎ সয়াবিনের প্রায় দ্বিগুণ পাম অয়েল আমদানি হয়। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে ৯ লাখ টন এবং মালয়েশিয়া ২ লাখ টন, সিঙ্গাপুর থেকে ৭ হাজার টন ও চীন থেকে ২৭০ টন পাম অয়েল আমদানি করে। ইন্দোনেশিয়া থেকে দেড় হাজার টন পাম অয়েল আমদানি এখনও অনিষ্পন্ন রয়েছে। এগুলো এখন আর আমদানি করা যাবে না।
এদিকে বাণিজ্যি মন্ত্রণালয় থেকে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর থেকে পাম অয়েল আমদানিরও প্রচেষ্টা চলছে। তবে সিঙ্গাপুরেও এর দাম বেড়ে গেছে। আগে সিঙ্গাপুরের বাণিজ্যিক রপ্তানিকারকরা (মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া থেকে কিনে সিঙ্গাপুরে পাইকারিভাবে বিক্রি করে) প্রতি টনে ৪০ ডলার ছাড় দিতেন। রোববার থেকে এ ছাড় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
পেঁয়াজ আমদানিতে বাংলাদেশ এককভাবে ভারতের ওপর নির্ভরশীল। দেশে পেঁয়াজের নিট উৎপাদন হয় ২৮ লাখ টন। এর বাইরে আরও ৬-৮ লাখ টন আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ভারত থেকেই আমদানি করা হয় ৫-৭ লাখ টন। বাকি ১ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করে মিয়ানমার, মিসর, তুরস্ক থেকে। কিন্তু ভারতে পেঁয়াজের উৎপাদন কমে গেলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। তখনই দেশে পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে এর দাম কেজিতে ৩০০ টাকায় উঠে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরেও ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করছিল। ওই সময়েও দেশের পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে উঠে। দুই বছরই ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করলে মিয়ানমার, তুরস্ক থেকে আমদানি করা হয়। কিন্তু তাৎক্ষনিকভাবে ওইসব দেশ থেকে আমদানি করা জটিল হয়ে উঠে। আমদানির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ২-৩ মাস লেগে যায়। তত দিনে দেশি পেঁয়াজ বাজারে চলে আসে। ভারত প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় এ দেশ থেকে পেঁয়াজ আমদানির খরচ কম। মিয়ানমার থেকেও আমদানি খরচ কম। কিন্তু মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য খুবই কম। এছাড়া রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের শীতলতা থাকায় স্থল বাণিজ্য বন্ধ। খুবই সীমিত আকারে নৌপথে কিছু বাণিজ্য হচ্ছে। তুরস্ক থেকে আমদানিতে খরচ বেশি পড়ে।
গমের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। বেশিরভাগ গম আমদানি করে রাশিয়া ও উইক্রেন থেকে। ওইসব দেশে গমের উৎপাদন কম হলেই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যায়। সাম্প্রতিক রাশিয়া ও উইক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ বাধায় আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বেড়ে গেছে। এর প্রভাবে বেড়েছে দেশের আটার দাম। ৩২ টাকা দামের আটা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪২ টাকা কেজি। অথচ অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, আজেন্টিনাতেও গমের উৎপাদন ভালো। ওইসব দেশ থেকে গম আমদানিতে খরচ বেশি হওয়ায় সেসব দেশ থেকে পণ্যটি আমদানি করে না উদ্যোক্তারা।