ভেজাল খাদ্যপণ্যে ছেয়ে গেছে দেশ। বস্ত্রকলের কাপড়ের রং দিয়ে তৈরি খাদ্যে বাজার সয়লাব। বিশুদ্ধ খাবার খুঁজে পাওয়া ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। সারাবিশ্বে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয় এমন কেমিক্যাল ‘ফুড গ্রেড’ খাদ্যে মেশানো হয়। কিন্তু দেশে ফুড গ্রেডের নামে প্রতারণা করা হচ্ছে। দেশের অধিকাংশ খাদ্য সামগ্রীতে ফুড গ্রেড ব্যবহার না করে কাপড়ের রং মেশানো হচ্ছে। তাই আমরা খাবারের নামে খাচ্ছি বিষাক্ত কেমিক্যাল।
কিডনি ও ক্যান্সারসহ নানা মরণব্যাধির জন্য দায়ী এই ভেজাল খাদ্য। খাদ্যে ভেজাল বন্ধ করার জন্য দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু কোন প্রতিষ্ঠানই কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে না।
খাদ্যে ভেজাল রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, বিশ্বের প্রায় সব দেশে খাদ্যে ভেজালের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
কঠোর এই শাস্তি প্রণয়নের ব্যাখ্যা দিয়ে তারা বলেন, একজন সন্ত্রাসী একজনকে হত্যা করে। কিন্তু খাদ্যে ভেজাল প্রদানকারী পুরো জাতিকে হত্যা করে। এ কারণে কেউ খাদ্যে ভেজাল দিয়েছে প্রমাণিত হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। আমাদের দেশে সামান্য জেল-জরিমানা। খাদ্যে ভেজাল দিয়ে মুনাফালোভীরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে, জেল-জরিমানা তাদের কাছে একেবারেই সামান্য। এ কারণে জেল-জরিমানাকে তোয়াক্কা করে না। তারা খাদ্যে ভেজালের কাজ করেই যাচ্ছে।
র্যাব, বিএসটিআই ও ভোক্তা অধিকার বিভিন্ন সময় খাদ্যে ভেজাল বিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে। জেল-জরিমানা দিয়েও যাচ্ছেন। অভিযুক্তরা র্যাবের কাছে স্বীকার করে বলেছেন, ফুড গ্রেডের মূল্য অনেক বেশি। অথচ এক কৌঠা কাপড়ের রংয়ের মূল্য অনেক কম। অনেক দিন ব্যবহারও করা যায় এই রং। এই কারণে তারা খাদ্যে কাপড়ের রং ব্যবহার করেন। শুক্রবার রাজশাহীতে কাঁচা আমের কালারে মিষ্টি তৈরি করার সময় মোবাইল কোর্ট অভিযান চালিয়ে বন্ধ করে দেয়। এক্ষেত্রে ফুড গ্রেড ব্যবহার হয়েছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।
র্যাবের আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম র্যাবে থাকাকালে সম্প্রতি রাজধানীর গুলশান, বনানীসহ অভিজাত এলাকায় অভিযান চালিয়ে শতাধিক রেস্টুরেন্টকে জেল-জরিমানা করেন। এ সময় রেস্টুরেন্টে খাদ্যে মেশানো কাপড়ের রংয়ের কৌঠাও জব্দ করেন। ওই সময় তারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারও ব্যবহার করেছেন যে, কাপড়ের রং বিভিন্ন খাদ্যে ব্যবহার করে আসছে।
বাংলাদেশ খাদ্য পরীক্ষাগারের একটি তথ্যে জানা যায়, ১০০টি খাদ্যের মধ্যে মাত্র দুই একটিতে ফুড গ্রেড ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাকিগুলোতে ফুড গ্রেড ব্যবহারের প্রমাণ মেলেনি। এটা অনেকটা বিপদজনক তথ্য। এছাড়া খাদ্য পরীক্ষাগার বাংলাদেশে বাজারজাতকৃত খাদ্য সামগ্রীর মধ্যে পরীক্ষাগারে ১০৭ ধরনের খাদ্য পরীক্ষা করে আসছে। যার ৯৮ ভাগই ভেজাল ও বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে। খাদ্যে ভেজাল নিয়ে দেশে বড় ধরনের গবেষণা হয় না। সম্প্রতি শ্রীলংকায় বড় ধরনের একটি গবেষণা হয়েছে। শ্রীলংকায় ধানে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে হেভি মেটাল পাওয়া যায়। পরবর্তীতে চালের মধ্যেও হেভি মেটাল পাওয়া গেছে। এই চালের ভাত খেয়ে দেশটিতে কিডনি ও ক্যান্সার রোগী ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। পরীক্ষায় প্রমাণ হয়, চালের মধ্যে হেভি মেটাল থাকার কারণে কিডনি ও ক্যান্সারসহ রোগ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
ইত্তেফাকের এই প্রতিনিধি সম্প্রতি ব্যাংককের বুমরুনগ্রাদ আন্তর্জাতিক হাসপাতাল সরেজমিনে ক্যান্সার বিভাগে গিয়ে দেখেন, সেখানে ভর্তি রোগীর মধ্যে ৬০ ভাগই বাংলাদেশি নারী-পুরুষ ও শিশু।
সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, বেশিরভাগই ভেজাল খাদ্যের কারণে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে তারা মনে করছেন। কারণ তাদের রক্তে নানা ধরনের কেমিক্যালের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। প্রতিবছর ভেজাল খাদ্য খেয়ে সব বয়সের মানুষ ব্যাপক হারে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে।
চিকিৎসকরা বলেন, এই সংখ্যা দেড় লক্ষাধিক। খাদ্যে ভেজালের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে শিশু ও গর্ভবতী মায়ের। বাজারে পাওয়া শিশু খাদ্যের বেশিরভাগই ভেজাল। দেশে প্রতিবছর যত শিশু মারা যায় তার ১০ শতাংশের কারণ ভেজাল ও বিষাক্ত খাদ্য। কাপড়ে ব্যবহৃত রঙ, কৃত্রিম ফ্লেভার, ঘনচিনি ও স্যাকারিনের দ্রবণ মিশিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন ধরনের জুস ও জেলিসহ ভেজাল খাদ্যপণ্য। আর এসব পণ্যের প্রধান ভোক্তা হচ্ছে শিশুরা। এজন্যই বাংলাদেশের দেড় থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে।
জাতীয় জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ২০১৮ সালে সারাদেশে ৪৩টি ভোগ্যপণ্যের (খাদ্যদ্রব্য) মোট ৫৩৯৬টি নমুনা পরীক্ষা করে। অত্যন্ত দুঃখজনক এবং আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পর এই ৪৩টি পণ্যেই ভেজাল পাওয়া গেছে। বর্তমানে বাজারে খাদ্য সামগ্রীর মানের অবস্থা একই।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আকরাম হোসাইন বলেন, দেশের ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে ৩০ ভাগেরই ক্যান্সার হয়েছে খাদ্যে ভেজালের কারণে। এছাড়া পরিবেশগত নানা কারণে ফুসফুসের ক্যান্সার হচ্ছে। দুষিত বাতাসে কার্বন-মন অক্সাইড ও সালফাইল থাকে।
তিনি বলেন, দেশে তেমন কোন স্টাডি নেই, তবে ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রোগব্যাধির মধ্যে ৬ষ্ঠ স্থানে ক্যান্সার।
অধ্যাপক ডা. আকরাম হোসাইন বলেন, আমরা যে খাদ্য খাচ্ছি তা বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো বিষ। এটা নীরবে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ক্যান্সার সৃষ্টি করছে। বর্তমানে ক্যান্সার রোগী ব্যাপক হারে বাড়ছে। ক্যান্সার হাসপাতালে রোগী ভর্তি করতে এখন প্রায় দুই মাস অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নিজাম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, দেশে খাদ্যে বস্ত্রকলের রং ব্যবহার করা হচ্ছে। এটা কিডনির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। পরীক্ষাগারে তথ্যানুযায়ী, খাদ্যে হেভি মেটাল পাওয়া যাচ্ছে-যা আগুনেও নষ্ট হয় না। এতে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ধীরে ধীরে ডেমেজ হয়ে যায়। হেভি মেটাল মিশ্রিত খাদ্য গ্রহণ করলে কিডনিসহ যেকোনো অঙ্গে ক্যান্সার হতে পারে।