তাসপিয়া আক্তার জান্নাত। চার বছর বয়সী ছোট্ট শিশু। দুই মাস হলো প্রবাসী পিতা আবু জাহের দেশে ফিরেছেন। বাবার কাছে কন্যার হরেক রকমের আবদার-বাহানা। বুধবার বলে, বাবা চিপস ও চকলেট কিনে দাও। মেয়েকে স্থানীয় দোকানে নিয়ে যান বাবা। কে জানতো বাবার কাছে জান্নাত আর কোনোদিন কিছু চাইবে না। বাবার কোল।
পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। কিন্তু সেখানেও শিশুটিকে বাঁচতে দিলো না সন্ত্রাসীরা। গুলি করে নির্মমভাবে খুন করে তাকে। গুলিবিদ্ধ হন পিতাও। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার হাজীপুর গ্রামের মালেকার বাপের দোকান এলাকায় বুধবার বিকালে এ ঘটনাটি ঘটে। জানা গেছে লোমহর্ষক পুরো ঘটনার বর্ণনা। এতে তোলপাড় নোয়াখালী জুড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, জান্নাতকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার ঘটনায় জড়িত পার্শ্ববর্তী দুর্গাপুর ইউনিয়নের চিহ্নিত সন্ত্রাসী রিমন। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। নিহতের নিকটাত্মীয় এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ব্যবসায়ী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, গত কয়েকদিন আগে আমাদের বাড়ির আল আমিন নামে এক ব্যক্তি জমিনের মাটি বিক্রি করে রিমনের এলাকার বাদশার কাছে। বাদশা ওই জায়গা থেকে ৬ ফিট মাটি কাটে। এরপর আরও মাটি কাটতে গেলে আমাদের বাড়ির লোকজন তাদের বাধা দেয়। বলে যে, এভাবে মাটি কাটলে আমাদের জায়গা ভেঙে পড়বে। মাটি কাটতে বাধা দেয়ার খবর পেয়ে সন্ত্রাসী রিমন ও তার লোকজন আমাদের বাড়িতে এসে গোলাগুলি করে এবং সন্তানসম্ভবা ভাগ্নির পেটে আঘাত করে। বিষয়টি পুলিশকে জানালে পুলিশ ওই নারীকে প্রথমে চিকিৎসা দিতে বলে। মামুন আরও বলেন, মাটি কাটার বিরোধের জের ধরে বুধবার বিকাল ৪টার দিকে রিমন ও তার বাহিনীর সদস্যরা মালেকার বাপের দোকান এলাকায় অবস্থিত আমার দোকানে এসে আমাকে গালিগালাজ করে। আমার মামা জাহের তার শিশু মেয়ে জান্নাতকে নিয়ে দোকানে আসে চিপস ও চকলেট কিনতে এ সময় সন্ত্রাসী রিমন মামাকে আমার দোকানে দেখে গালমন্দ করে বলে তোর শেল্টারে এরা এসব করছে। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়ে। জান্নাতকে ইট দিয়ে আঘাত করে। এরপর মামা দোকান থেকে বের হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে রিমন ও তার বাহিনীর সদস্যরা পিছন থেকে পুনরায় জান্নাতকে এবং মামাকে লক্ষ্য করে গুলি করলে জান্নাত কানে, মাথায় এবং চোখে গুলিবিদ্ধ হয়। স্থানীয় এলাকাবাসী তাদের উদ্ধার করে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাদের দু’জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা নেয়ার পথে রাত সাড়ে ৮টার দিকে জান্নাত মারা যায়।
আহত জাহের গণমাধ্যমকে বলেন, আমার মেয়ে ইটের আঘাতে ভয়ে পেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। আমি মেয়েকে বুকে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু পরনের লুঙ্গি ঢিলে হওয়ার কারণে পারিনি। এ সময় পেছন থেকে রিমন ও তার সহযোগীরা আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এতে আমার ও মেয়ের শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। আবু জাহের বলেন, আট বছর পরে আমারে একটা মেয়ে দিছে আল্লাহ। আমার কলিজাটারে শেষ করে দিছে। আমি নিঃস্ব হয়ে গেলাম। আমি ওই সন্ত্রাসীদের ফাঁসি চাই।
জান্নাতের মা জেসমিন আক্তার জানান, তার স্বামী দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। দুই মাস আগে মেয়েকে দেখতে দেশে ফিরেন। বিকালে মেয়ে তার বাবার কাছে বায়না ধরে তাকে চিপস কিনে দিতে। তখন তার স্বামী আবু জাহের মেয়েকে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরের মালেকার বাপের দোকান এলাকায় যান। কিছুক্ষণ পরই জানতে পারেন সন্ত্রাসীরা তার স্বামী ও মেয়ের ওপর গুলি করেছে। জেসমিন আক্তার অভিযুক্তদের ফাঁসি দাবি করেন।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বেগমগঞ্জ সদর (সার্কেল) নাজমুল হাসান রাজীব (পিপিএম) এ ব্যাপারে মানবজমিনকে বলেন, ‘খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। এ ঘটনায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। পুলিশ চারজনকে আটক করেছে। অভিযুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশ চেষ্টা চালাচ্ছে।’