বারো বছর বয়সী আলামিনের বাড়ি গত বছর পর্যন্ত ছিলো বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ইলশা নদীর তীরে। তবে নদীভাঙনে বসতভিটা ও কৃষি জমি হারিয়ে তারা এখন বাস করছে ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি বস্তিতে। রয়টার্স আলামিনের বাবা কয়েক বছর আগে ক্যান্সারে মারা গেছেন। সে এখন জাহাজ ভাঙার ক্রু হিসেবে কাজ করছে, তার মা শ্রমিকদের জন্য রান্না করছেন। এতে তাদের নিজেদের ও দুই ছোট ভাইয়ের খাবার খরচ উঠে যায়। বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে বন্যা, ক্ষয় ও ঝড়ের কবলে পড়ে আলামিনের মতো হাজার হাজার পরিবার ঢাকার বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সন্তানের জন্য এর মানে স্কুল জীবনের সমাপ্তি ও শিশু বয়সে কঠোর কর্মজীবনের শুরু।আগস্টে এক প্রতিবেদনে, জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ বলেছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর শিশুরা এখন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ‘অত্যন্ত উচ্চ’ ঝুঁকির সম্মুখীন। বিশ্বব্যাপী ৩৩টি দেশের প্রায় এক বিলিয়ন শিশু এই ধরনের হুমকির সম্মুখীন। ইউনিসেফের দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক জর্জ লারিয়া-আদজেই বলেছেন,‘প্রথমবারের মতো আমরা দক্ষিণ এশিয়ার লাখ লাখ শিশুর ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সুস্পষ্ট প্রমাণ হাতে পেয়েছি। এই অঞ্চল জুড়ে খরা, বন্যা এবং নদী ভাঙ্গনের কারণে লক্ষ লক্ষ শিশু গৃহহীন, ক্ষুধার্ত, স্বাস্থ্যসেবা এবং নিরাপদ পানির অভাবে রয়েছে।’ প্রায় ৭০০টি নদীর উর্বর ব-দ্বীপ বাংলাদেশে বন্যা, বন্যাজনিত ক্ষয় ও পুনর্বাসনের কারণে শত শত গ্রামীণ পরিবার শহরের বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই শিশু, এই পদক্ষেতে সবচেয়ে বেশি মূল্য দিচ্ছে তারা। ইউনিসেফের মতে, শহুরে বস্তিতে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করা বেশিরভাগ বাংলাদেশী শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় না। সংস্থার গবেষণায় দেখা গিয়েছে, দেশে প্রায় ১.৭ মিলিয়ন শিশু শ্রমিক, তাদের চারজনের মধ্যে একজনের বয়স ১১ বছর বা তার কম। মেয়ের কাজ করে গৃহশ্রমিক হিসেবে। ঢাকার আশেপাশের বস্তিতে, শিশুরা ট্যানারি, শিপইয়ার্ড, টেইলারিং বা অটোমোবাইল মেরামতের কাজ করছে। অন্যরা সবজি বাজারে বা বাস, ট্রেন এবং বোট টার্মিনালে লাগেজ বহনের কাজ করছে। ঢাকার একটি সবজি বাজারে কাজ করা ১০ বছর বয়সী আলাউদ্দীন জানায়, সে আগে জামালপুরের একটি প্রাইমারি স্কুলে পড়তো। গত বছরের বন্যায় তার পরিবারের বাড়ি ও জমি শেষ হয়ে যাওয়ার পর তারা ঢাকার একটি বস্তিতে চলে আসে। তার বাবা এখন রিক্সা চালায় ও মা একটি স্কুলে ক্লিনার হিসেবে কাজ করে। আলাউদ্দীন বাজারে কাজ করে প্রতিদিন ১০০ টাকা আয়। তার বাবা বলেন, এই টাকা ছাড়া সংসার চলবে না। আমার ছেলেরা আর স্কুলে যেতে পারবে না। আমরা কিভাবে খরচ চালাবো? বাংলাদেশের বার্ষিক প্রাথমিক বিদ্যালয় আদমশুমারি অনুযায়ী ২০২১ সালে ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে ১০.২৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থী। তবে ২০২১ সালে ড্রপ-আউটের হার ছিল ১৭ শতাংশ এর বেশি। অর্থাৎ স্কুল ছেড়েছে ২ মিলিয়নেরও বেশি শিশু। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মোহাম্মদ মনসুরুল আলম ঝরে পড়ার হারকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে অভিহিত করে বলেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন এর একটি বড় কারণ। গত বছরের বন্যায় ৫০০ টিরও বেশি বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ধরে স্কুলে যেতে পারেনি। তাদের একটি বড় সংখ্যাক আর স্কুলে ফেরেনি, বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়েছে। দেশের বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশে ১৪ হাজারের বেশি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মহামারীর কারণে অস্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আইএলওর বাংলাদেশ অফিসের পরিচালক তুওমো পাউটিয়ানেন বলেছেন, ‘কাজ করতে বাধ্য করা শিশুরা শারীরিক ও মানসিক উভয় ধরনের ক্ষতির পাশাপাশি শিক্ষার সুযোগ হারাতে পারে, যা তাদের ভবিষ্যৎ সুযোগকে সীমিত করতে পারে এবং দারিদ্র ও শিশুশ্রমের চক্রের দিকে পরিচালিত করতে পারে।’ বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট যোগ করেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য শিশুরা উচ্চ মূল্য দিচ্ছে।’