পুলিশী অভিযান আর ধরপাকড়ের মধ্যে চট্টগ্রামে দৌঁড়ের ওপর রয়েছে ছিনতাইকারীরা। চুরি, ডাকাতি, দস্যুতায় জড়িতদের বিরুদ্ধেও চলছে অভিযান। পবিত্র মাহে রমজানের আগেই পুলিশ অপরাধীদের প্রতিরোধে মাঠে নেমে পড়ায় সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। চলতি রমজান মাসে এখনও পর্যন্ত বড় ধরনের কোন অপরাধের ঘটনা ঘটেনি। তাতে কিছুটা স্বস্তিতে রোজাদারেরা।
তবে ঈদ সামনে রেখে নীরব চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পেশাদার চাঁদাবাজ ও রাজনৈতিক দলের ক্যাডার মাস্তানেরা আড়ালে থেকেই শুরু করেছে চাঁদাবাজি। বিভিন্ন সংগঠনের নামেও চলছে চাঁদাবাজি। প্রাণভয়ে চুপিসারে তাদের দাবি আদায় করে চলেছেন ভুক্তভোগীরা। ফলে বিষয়টি থানা পুলিশের নজরে আসছে না। যদিও নগর ও জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, চাঁদাবাজির কোন অভিযোগ পেলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অন্য বছরের তুলনায় এবার রমজানে বন্দরনগরীসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। অপরাধ দমনে র্যাব-পুলিশ আগাম প্রস্তুতি নেয় এবার। রমজানের আগেই নগরীতে পেশাদার ছিনতাইকারী ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামে পুলিশ। তাদের তালিকা ধরে বাসা বাড়ি ও সম্ভাব্য অবস্থানে হানা দেয়া হয়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে থানা পুলিশ ও ডিবি পুলিশের হাতে কমপক্ষে অর্ধশত ছিনতাইকারী, ডাকাত ও পেশাদার অপরাধী ধরা পড়ে। অভিযানের মুখে অনেকে পালিয়ে যায়।
নগরীতে অপরাধ দমনে বিশেষ করে ছিনতাই, ডাকাতি ও দস্যুতা দমনে পুলিশী অভিযান, চেকপোস্টে তল্লাশি, ব্লক রেইড ও রাত্রীকালীন টহল ও পিকেট ডিউটি জোরদার করা হয়। এতে অপরাধীরা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। মাদকের কারবারিদের বিরুদ্ধেও পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। কারাগার থেকে কোন কোন পেশাদার অপরাধী ছাড়া পাচ্ছে, সে বিষয়েও নজরদারী বাড়ানো হয়। থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশও অভিযান জোরদার করে। সাদা পোশাকে তারা নগরীতে টহল অব্যাহত রেখেছে। গত ৪ এপ্রিল নগরীতে গোয়েন্দা পুলিশের তিনটি অভিযানে ১১ জন পেশাদার ছিনতাইকারী গ্রেফতার হয়। খুলশী থানার আমবাগান, টাইগার পাস ও সদরঘাট থানার রশিদ বিল্ডিং এলাকায় এ অভিযান পরিচালনা করা হয়। অভিযানে মো. জাহিদ (৩০), মিন্টু দাশ (৩১), বেলাল হোসেন ওরফে বিল্লাল (৩২), বিপ্লব চৌধুরী (৪৩), মো. সাকিব (২৫), সুমন ওরফে চাকমা সুমন (২৩), রুবেল কান্তি দাশ ওরফে রুবেল হোসেন (৩৪), নুরুল ইসলাম ওরফে নুরু (৪৫), জসিম উদ্দিন (২৫), খোকন হাওলাদার (৩০) ও মো. খোকনকে (২৫) পাকড়াও করা হয়। তাদের মিন্টু ২০১৩ সালে নগরীর খুলশীতে রেঞ্জ ডিআইজির বাসভবনে দায়িত্বরত পুলিশ হত্যা মামলার আসামি।
ডিবি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মূলত ঈদ বাজারে ছিনতাই করার জন্য তারা সংঘবদ্ধ হয়েছিল। তাদের কয়েকজন জেলে বসে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে। এরপর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ছিনতাইয়ে নামে। বেলাল ও মিন্টু গত ১ এপ্রিল জামিনে ছাড়া পায়। কারাগার থেকে বের হয়ে পুনরায় ছিনতাই কাজে জড়িয়ে পড়ে তারা। গ্রেফতার জাহিদ, মিন্টু, বেলাল ও বিপ্লব তাদের আরও কয়েকজন সহযোগী নিয়ে টাইগারপাস মোড়ের পশ্চিম দিকে অবস্থান করছিল। সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় তাদের। এ সময় তাদের মধ্যে জাহিদ ও মিন্টু কাছ থেকে দুইটি ছুরি জব্দ করা হয়।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, এ চক্রটি সন্ধ্যা ও ভোর বেলাকে টার্গেট করে ছিনতাই করে থাকে। তাদের মূল টার্গেট বিভিন্ন মার্কেটের ক্রেতা এবং বাস ও ট্রেন যাত্রীরা। সন্ধ্যায় ইফতারের সময় এবং ভোরে সড়কে যান চলাচল কম থাকায় তারা ওই সময়টিকে বেছে নেয় ছিনতাইয়ের জন্য। গ্রেফতার মিন্টু ডিআইজি বাংলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কনস্টেবল আব্দুল কাইয়ুম হত্যা মামলার আসামি। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর নগরীর খুলশী থানার আমবাগান এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেয়ায় ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় কনস্টেবল কাইয়ুমকে। এ সময় তার তিন সহকর্মীও আহত হয়েছিল।
গত ৫ এপ্রিল বায়েজিদ এলাকা থেকে অস্ত্রসহ দুই ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে বায়েজিদ থানা পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি দেশীয় তৈরি পাইপ গান, চার রাউন্ড কার্তুজ ও দুটি টিপছোড়া উদ্ধার করা হয়। তারা হল- বায়েজিদ থানার অক্সিজেন বেপারিপাড়া এলাকার ইদ্রিস আলী অভি (২২) এবং অক্সিজেন বেপারিপাড়া এলাকার জাহিদ হাসান মুরাদ (২৩)। অভি ও মুরাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় আটটি করে মামলা আছে।
পুলিশ জানায়, তারা সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য। চক্রটি নগরীতে মোটরসাইকেল নিয়ে ছিনতাই করে বেড়াতো। সিএনজি, অটোরিকশা ও পথচারীদের টার্গেট করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সর্বস্ব ছিনিয়ে নিতো। এর পরদিন বাকলিয়া থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় পাঁচ ছিনতাইকারীকে। গত কয়েকদিনে নগরীর বিভিন্ন থানা এলাকা থেকে বেশ কয়েকজন পেশাদার ছিনতাইকারী ও ডাকাতকে পাকড়াও করে পুলিশ। পুলিশি অভিযান জোরদার হওয়ায় ছিনতাই, ডাকাতি, দস্যুতাসহ অপরাধ কমছে বলে জানান নগর পুলিশের কর্মকর্তারা।
এদিকে ঈদ সামনে রেখে চাঁদাবাজদের উৎপাত বাড়ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পেশাদার চাঁদাবাজ এবং রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, মাস্তানেরা নিরবে চাঁদাবাজি শুরু করেছেন। ব্যবসায়ী, শিল্পপতি থেকে শুরু করে ফুটপাতের ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, মাস্তান এবং চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। ক্যাডার, মাস্তানরা আড়ালে থেকে তাদের গ্রুপের কিশোর এবং উঠতি সন্ত্রাসীদের দিয়ে চাঁদা আদায় করছে। বিভিন্ন পরিবহন সমিতির নামেও চলছে চাঁদাবাজি।
নগরীর বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী বৈধ, অবৈধ যানবাহন চালকদের কাছ থেকে চাঁদা নেয়া হচ্ছে। জেলার বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী গণপরিবহন ও পণ্য পরিবহনের চালকদের কাছ থেকেও ঈদ বখশিশের নামে চাঁদাবাজি করা হচ্ছে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মাছ, তরকারি, শাকসবজিবাহি যানবাহন থামিয়ে সড়কের মোড়ে মোড়ে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভুক্তভোগীরা নিরাপধে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ার জন্য নীরবেই চাঁদাবাজদের দাবি আদায় করে চলেছেন। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, চাঁদাবাজির তেমন কোন অভিযোগ তাদের কাছে নেই।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, রমজানে সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক রাখতে আগাম ব্যবস্থা নেয়া হয়। রোজার শুরুতেই পেশাদার অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা হয়। আর তাতে সুফল মিলেছে। নগরবাসী স্বস্তিতে পবিত্র মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা করতে পারছেন। সামনের দিনগুলোতে অভিযান আরও জোরদার হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করি ঈদ পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বাভাবিক অবস্থা বজায় থাকবে। ঈদ সামনে রেখে চাঁদাবাজির কোন অভিযোগ থানার কাছে নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, অভিযোগ পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সিএমপির উপ-কমিশনার (উত্তর) মোখলেসুর রহমান বলেন, রোজার প্রথম দিন থেকে পুলিশ মাঠে রয়েছে। পেশাদার চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, চোর, ডাকাত ও মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। এতে তারা আতঙ্কে এলাকা ছাড়া। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সার্বক্ষণিক পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে।